শব্দার্থ পরিবর্তন কাকে বলে ও কয় প্রকার
কোনো শব্দ ভাষায় বহুদিন ব্যবহৃত হলে একদিকে যেমন ভাষায় জীর্ণতা আসে অন্যদিকে তেমনি মানসিক কারণ বা বহিঃপ্রভাবের ফলে অর্থে অনাবশ্যক বস্তুর সঞ্চয় জমে তাকে পৃথুলতাও দান করে। অর্থাৎ ভাষায় অনেক শব্দই চিরকাল একই অর্থে ব্যবহৃত হয় না , অর্থের পরিবর্তন হয়ে যায়। এইভাবে, ভাষায় ব্যবহৃত শব্দের আদি অর্থ কালক্রমে নানা ভাবে বিবর্তিত হয়ে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভিন্ন অর্থে উপনীত হবার প্রক্রিয়াকে বলে শব্দার্থ পরিবর্তন। শব্দার্থ পরিবর্তনের ধারা কটি, এ সম্পর্কে নানা মত থাকলেও একে মোটামুটি পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা হয়। যথা – ১) অর্থপ্রসার বা অর্থ বিস্তার ২) অর্থসংকোচন ৩) অর্থসংশ্লেষ বা অর্থসংক্রম ৪) অর্থের উৎকর্ষ বা অর্থোন্নতি ৫) অর্থের অপকর্ষ বা অর্থাবনতি।
শব্দার্থ পরিবর্তনের বিভিন্ন ধারা
১. অর্থবিস্তার বা অর্থপ্রসার
যদি কোনো শব্দ প্রথমে কোনো সংকীর্ণ ভাব বা সীমাবদ্ধ বস্তু কে বোঝায় এবং কিছুকাল পরে ব্যাপক ভাব বা অধিকতর বস্তুকে বোঝায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে অর্থবিস্তার বা অর্থপ্রসার বলে।
অর্থ বিস্তারের উদাহরণ
শব্দ – মূল অর্থ – পরিবর্তিত অর্থ
১. বর্ষ – বর্ষাকাল – বৎসর
২. পরশু – আগামীকালের পরের দিন – আগামীকালের পরের দিন এবং গতকালের আগের দিন
৩. কালি – কালো রঙের – যেকোনো তরল
৪. মীরজাফর – মূলত এক ব্যক্তিনাম – যেকোনো বিশ্বাসঘাতক
৫. গাঙ – গঙ্গা নদী – যেকোনো নদী
৬. কুশীলব – লব ও কুশ – নাটকের পাত্রপাত্রী
৭. তৈল – তিল থেকে জাত – যেকোনো তেল
৮. প্রশস্ত – প্রশংসিত – বিস্তৃত
৯. গৌরচন্দ্রিকা – গৌরাঙ্গের লীলা বিষয়ক সংগীত – যেকোনো বিষয়ের গোড়ার কথা
১০. মার্গ – মৃগ চলার পথ – যেকোনো পথ
১১. ধন্য – ধনবান বা বিত্তশালী – সৌভাগ্যবান
১২. মৌন – মুনির ভাব – নীরবতা
১৩. যথেষ্ট – ইচ্ছামতো – প্রচুর
১৪. সত্তা – সদভাব – অস্তিত্ব
১৫. সম্বল – পাথেয় – অবলম্বন
১৬. কুমোর – মাটির কলসী তৈরি করেন – মাটির যেকোনো জিনিস
১৭. বৃহৎ – যা বৃদ্ধিশীল – প্রকাণ্ড
১৮. স্বত্ব – নিজস্বতা – মালিকানা
১৯. সাগর – সগরবংশীয় – সমুদ্র
২০. মীমাংসা – সিদ্ধান্ত – সমাধান
২১. বদন – যার দ্বারা বলা হয় – মুখমণ্ডল
২২. ফলাহার – ফল আহার – নিরামিষ খাবার
২৩. পত্র – গাছের পাতা – চিঠি অর্থেও ব্যবহৃত
২৪. যবাগু – যবের মণ্ড – চালের মন্ডও হয়।
২৫. শ্বশুর – স্বামীর পিতা – এখন কন্যার পিতাও
২৬. রাজপুত – রাজার পুত্র – জাতিবিশেষ
২. অর্থ সংকোচন
প্রথমে কোনো শব্দের অর্থ যদি একাধিক বস্তুকে বা ব্যাপকভাবকে বোঝায় এবং কিছুকাল পরে যদি তার অর্থ একাধিক বস্তু বা ব্যাপক ভাবকে না বুঝিয়ে তার একটিমাত্র ভাব বা বস্তুকে বোঝায় তবে সেই প্রক্রিয়াকে অর্থসংকোচ বলে।
অর্থ সংকোচের উদাহরণ
শব্দ – মূল অর্থ – পরিবর্তিত অর্থ
১. অন্ন – খাদ্য – ভাত
২. মৃগ – যেকোনো পশু – হরিণ
৩. মুনিশ – মানুষ বা মনুষ্য – মজুর শ্রেণির মানুষ
৪. প্রদীপ – আলো বা দীপ – এক বিশেষ ধরনের দীপ
৫. আহ্নিক – প্রাত্যহিক – সন্ধ্যাবেলা
৬. গৃহস্থ – গৃহে স্থিত – সংসারী
৭. জগৎ – গমনশীল – পৃথিবী
৮. তপন – তপ্তকারী – সূর্য
৯. দণ্ড – দমন করার উপকরণ – দাঁত
১০. দাঁড় – দণ্ড – নৌকার ক্ষেপনী
১১. ব্যাঘ্র – বিশেষ ভাবে আঘ্রানকারী – বাঘ
১৩. বেদ – জ্ঞান – গ্রন্থ বিশেষ
১৪. প্রভাত – প্রকৃষ্টরূপে ভাত বা উজ্জ্বল – সকাল
১৫. ভুজঙ্গ – ভুজ বা হাতে ভর দিয়ে চলে এমন – সাপ
১৬. অনীকিনী – যুদ্ধে প্রয়োজন যার – সৈন্যদল
১৭. তুরঙ্গম – দ্রুতগতি সম্পন্ন – ঘোড়া
১৮. কৃপণ – কৃপার পাত্র – ব্যয়কুণ্ঠ ব্যক্তি
১৯. রাজস্ব – রাজার সম্পদ – খাজনা
২০. পান – গাছের পাতা – তাম্বুল
২১. পঙ্কজ – যা পাঁকে – পদ্মফুল
২২. আদিত্য – দেবাতার আদিতির পুত্র সব দেবতা – সূর্যদেব
২৩. জলদ – জল দান করে – মেঘ
২৪. স্নেহ – যেকোনো ধরনের প্রীতি – কনিষ্ঠে প্রীতি
২৫. মহোৎসব – মহান উৎসব – বৈষ্ণবদের উৎসব মচ্ছব
২৬. বিলাত – বিদেশ – ইংলেন্ড
২৭. সম্বন্ধী – সম্বন্ধ যুক্ত ব্যক্তি – বড় শ্যালক
২৮. খাজা – খাদ্য – বিশেষ ধরনের মিষ্টান্ন
২৯. ভালোমন্দ – ভালো ও মন্দ – যেকোনো একটি অর্থে প্রযুক্ত
৩০. মহাযাত্রা – মহাসমারোহে যাত্রা – মৃত্যুর উদ্দেশ্য যাত্রা
৩. অর্থসংশ্লেষ বা অর্থসংক্রম
কোনো শব্দের অর্থ পরিবর্তন হতে হতে এমন নতুন অর্থ দাঁড়ায় যে মূল অর্থের সঙ্গে তার যোগ সহজে পাওয়া যায় না। এই ধরনের পরিবর্তনকে অর্থসংশ্লেষ বা অর্থসংক্রম বলে।
অর্থসংশ্লেষ বা অর্থের রূপান্তরের উদাহরণ
শব্দ – মূল অর্থ – পরিবর্তিত অর্থ
১. শুশ্রূষা – শোনার ইচ্ছা – সেবা
২. বিবেক – পৃথক – বিচারবোধ
৩. ঘর্ম – গ্রীষ্ম – গ্রীষ্মজনিত স্বেদসুতি
৪. অবজ্ঞা – স্বল্প জ্ঞান – অবহেলা
৫. পাত্র – পান করার আধার – বর
৬. সন্দেশ – সংবাদ বা খবর – মিষ্টি খাবার
৭. চামচে – ছোট্ট হাতা – তোষামেদকারী
৮. গোষ্ঠী – গবাদি পশুর থাকার জায়গা – সমূহ
৯. কলম – শর বা খাগ – লেখনী
১০. গবেষণা – গরু খোঁজা – কোনো বিষয়ে নিয়মানুগ
১১. দারুণ – কাষ্ট নির্মিত – অত্যন্ত
১২. সুতরাং – অত্যন্ত – অতএব
১৩. সামান্য – সমানতা – অল্প
১৪. অভিসম্পাত – যুদ্ধের জন্য মুখোমুখি হাওয়া – অভিশাপ
১৫. জলপানি – জলখাবার – ছাত্রবৃত্তি
১৬. গবাক্ষ – গোরুর চোখ – জানালা
১৭.প্রবীন – যিনি বীনা বাজাতে পটু – মঙ্গল
১৮. অবশ্য – যা বশ করা যায় না – নিশ্চয়
১৯. আচ্ছন্ন – আবৃত – অচৈতন্য
২০. ইতি – এই – শেষ
২১. উপসর্গ – সৃষ্টির অনুরূপ – লক্ষণ
২২. কাণ্ড – গুড়ি – ব্যাপার
২৩. কলাপ – সমূহ – মহূয়ের পাখা
২৪. চক্রান্ত – চক্রের শেষ – ষড়যন্ত্র
২৫. পীত – যা পান করা হয়েছে – হলুদ বর্ণ
২৬. সহসা – বলপূর্বক – হঠাৎ
২৭. বিষম – অসম – অত্যন্ত
২৮. প্রসঙ্গ – প্রস্তাব – বিষয়
২৯. সহিত – হিতকারী – সঙ্গে
৩০. বিষয় – ঈষৎ হাস্য – আশ্চর্য
৪. অর্থের উৎকর্ষ বা উন্নতি
কোনো শব্দের অর্থ যদি এমন ভাবে পরিবর্তিত হয় যে শব্দটিতে প্রথমে যে ভাব বা বস্তু বোঝাতো তার চেয়ে সম্মানিত বা আদৃত ভাব বা বস্তুকে বোঝায় তাহলে তাকে অর্থোন্নতি বলে।
অর্থোন্নতির উদাহরণ
শব্দ – মূল অর্থ – পরিবর্তিত অর্থ
১. বাতুল – বায়ুগ্রস্ত বা উন্মাদ – বিশেষ ধর্মসম্প্রদায়
২. ভোগ – উপভোগ বা খাদ্যসামগ্রী – দেবতার উদ্দেশ্যে নিবেদিত ভোগ
৩. মন্দির – গৃহ – দেবালয়
৪. সাহস – হটকারিতা – নির্ভীকতা
৫. সম্ভ্রান্ত – সম্যক ভ্রান্ত – মর্যাদা সম্পন্ন
৬. দ্বিজ – দুবার জাত – ব্রাহ্মণ
৭. দুহিতা – দোহনকারী – কন্যা
৮. মণ্ডপ – মণ্ড পানের স্থান – দেবালয়
৯. হর – হরণকারী – শিব
১০. মার্জনা – মাজা – ক্ষমা
১১. দণ্ড – লাঠি – শাস্তি
১২. গোধূলি – গরুর ক্ষুরে উৎক্ষিপ্ত ধূলি – সন্ধ্যা
১৩. অদৃষ্ট – অদেখা – ভাগ্য
১৪. অপরূপ – কদাকার – অতি সুন্দর
১৫. অরুণ – সূর্য সারথি – সূর্য
১৬. ভীষণ – ভীতিপ্রদ – অতিশয়
১৭. সম্ভ্রম – ভয় – মান্য
৫. অর্থের অপকর্ষ বা অবনতি
কোনো শব্দের অর্থ পরিবর্তনের ফলে যদি এমন হয় যে, শব্দাটিতে পূর্বাপেক্ষা হেয় বা তুচ্ছ বিষয়কে বোঝায় তাহলে সেই প্রক্রিয়াকে অর্থাবনতি বলে।
অর্থের অপকর্ষের উদাহরণ
শব্দ – মূল অর্থ – পরিবর্তিত অর্থ
১. মহাজন – মহৎ ব্যক্তি – সুদখোর
২. ঝি – কন্যা – দাসী
৩. ইতর – অন্য – নীচ
৪. চামার – চর্ম ব্যবসায়ী – বদ লোক
৫. ঠাকুর – দেবতা – রান্নার লোক
৬. তল – পৃষ্ট – নিম্নদেশ
৭. নাগর – নগরবাসী – অবৈধ প্রণয়ী
৮. পদার্থ – পদের প্রতিপাদ্য – বস্তু
৯. বন্য – বনে জাত – বুনো
১০. বস্তি – বাসস্থান – আবর্জনাময় বসতি
১১. বেদনা – অনুভব – যন্ত্রণা
১২. বাড়ন্ত – বর্ধিষ্ণু – নিঃশেষিত
১৩. ভূত – অতীত – প্রেত
১৪. সমাচার – শিষ্টাচার – সংবাদ
১৫. সামান্য – সাধারণ – তুচ্ছ
১৬. বিরক্ত – নিরাসক্ত – উত্যক্ত
১৭. বুজুর্গ – মান্য ব্যক্তি – শঠ
১৮. মুনিষ – মানুষ – শ্রমিক
১৯. শালা – শ্যালক – গালিবিশেষ
২০. ওঝা – উপাধ্যায় – ঝাড়ফুঁক করা ব্যক্তি
২১. উজবুক – উজবেকিস্তানের জাতি – নির্বোধ
২২. অসুর – একশ্রেণির দেবতা – দানব
২৩. ভর্তা – ভরণপোষণ কারী অর্থাৎ স্বামী – ভাতার
২৪. রাগ – আকর্ষণ – ক্রোধ
২৫. দেবী – দেবকন্যা – মানবীদের উপাধি
লেখক: সজল দত্ত, এম.এ., বি.এড., অ্যাডমিন: ব্যাকরণের ক্লাসরুম।
আরও পড়ুন