এই অধ্যায়ে যা আছে
- ক্রিয়াপদের ধারণা, ক্রিয়াপদ কাকে বলে
- সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার উদাহরণ সহ পরিচয়
- সকর্মক ক্রিয়া, অকর্মক ক্রিয়া, এককর্মক ক্রিয়া ও দ্বিকর্মক ক্রিয়া
- যৌগিক ক্রিয়া
- যুক্ত ক্রিয়া
- নামধাতুজ ক্রিয়া
- প্রযোজক ক্রিয়া
- পঙ্গু ক্রিয়া
- অকর্তৃক ক্রিয়া
- বাংলা ক্রিয়াপদের গঠন।
Advertisement
ক্রিয়াপদ কাকে বলে
আগের অধ্যায়ে ধাতুর আলোচনার পর আমাদের পক্ষে ক্রিয়াপদের আলোচনা অনেক সহজ হয়ে গেছে। আজকের আলোচনায় আমরা ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ বা প্রকারভেদগুলি জেনে নেবো এবং বিভিন্ন প্রকার ক্রিয়াপদের গঠন সম্পর্কে জানব। তার আগে আসুন জেনে নিই ক্রিয়া কাকে বলে।
যে পদের দ্বারা কোনো কাজ করা বা হওয়া (আপনাআপনি হওয়া) বোঝায়, তাকে ক্রিয়াপদ বলে।
[ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় ক্রিয়ার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন, যে বিধেয়ের দ্বারা বাক্যের উদ্দেশ্য কোনো কাজ করছে বোঝায়, সেই বিধেয়কে ক্রিয়া বলে। তাঁর এই সংজ্ঞাতে অসমাপিকা ক্রিয়ার ধারণাটি বাদ গেছে, কারণ অসমাপিকা ক্রিয়া বিধেয় রূপে কাজ করে না। যাইহোক, ভাষাচার্যের মতে বাংলা বাক্যে ক্রিয়াপদ না থাকলেও চলে। যেমন : “ঈশ্বর পরম দয়ালু।” এই বাক্যে বিধেয়টি উদ্দেশ্য ‘ঈশ্বর’-এর গুণ প্রকাশ করছে মাত্র। এই বিধেয়টি কেবলই বিশেষণ। এখানে ‘হন’ ক্রিয়া যোগ করার কোনো যুক্তি নেই বলেই আমাদেরও মনে হয়। আসলে আমরা ইংরাজির am/is/are এর অনুসরণে এইসব বাক্যে একটি ক্রিয়া জুড়ে দিই। কিন্তু প্রকৃত বিচারে ওই ক্রিয়াটি বাক্যের ভাবকে অধিকতর পরিস্ফুট তো করেই না, বরং অর্থবোধে অন্তরায়ই সৃষ্টি করে। তার উপর,বাংলা ভাষার কথ্য বা লেখ্য, কোনো রূপেই উক্ত ‘হন’ জাতীয় ক্রিয়া কখনো ব্যবহৃত হয় না। যা কখনোই ব্যবহারে লাগে না, এমন পদের অস্তিত্ব ভাষায় স্বীকার করার কোনো যুক্তি নেই।*]
মনে রাখার বিষয় : ক্রিয়া হতে গেলে কাজের সম্পাদন বোঝাতেই হবে। শুধু কাজটির নাম বোঝালে ক্রিয়া হবে না। সেটি তখন ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য হয়ে যাবে। যেমন : খাওয়া – একটি বিশেষ্য। এটি ক্রিয়াপদ নয়। এর ভিতরে ক্রিয়ার ভাব থাকলেও কারও দ্বারা কাজটি সম্পাদিত হওয়া বা নিজে নিজে সম্পাদিত হওয়া বোঝাচ্ছে না। অবশ্য আধুনিক ব্যাকরণবিদদের অনেকেই এই ধরনের পদগুলিকে অসমাপিকা ক্রিয়া বলতে চান। সেক্ষেত্রে একটিই পদকে একই সঙ্গে ক্রিয়া ও বিশেষ্য, দুইই বলতে হবে। এমনটা হলে এই পদগুলির পরিচয়ের সংকট তৈরি হবে। তাই বাক্যের মধ্যে একটি পদ কী ভূমিকা পালন করছে, একমাত্র সেই বিচারেই পদপরিচয় স্থির করা ভালো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ‘খাওয়া’, ‘পড়া’, ‘দেখা’ প্রভৃতি পদগুলি বিশেষণ রূপেও কাজ করে। তখন তাদের ক্রিয়াবাচক বিশেষণ বলবো।
ক্রিয়ার উদাহরণ : আমি খাই। তুমি যাবে। রাম খেলছে।
বাবা আসবেন। রঞ্জন দেখল । সোনাই মন দিয়ে পড়ত ।
সে খেয়ে এসেছে। রমা গাইতে থাকবেে। আমরা খেলতে যাচ্ছি। তুমি এলে আমি যাব। ইত্যাদি।
ক্রিয়াপদের প্রকারভেদ
ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ করার একাধিক মাপকাঠি আছে। আমরা একটি একটি করে প্রতিটি মাপকাঠির বিচারে ক্রিয়ার প্রকারভেদ নির্ণয় করব।
প্রথমে দেখব ভাবের সম্পূর্ণতার বিচারে ক্রিয়া কত প্রকার :
বাক্যের ভাবকে সম্পূর্ণ করতে পারল কি না, এই বিচারে ক্রিয়াকে ২টি ভাগে ভাগ করা হয় :
সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়া
একটি বাক্য নেওয়া যাক: “আমি ভাত খেয়ে স্কুলে যাবো।” এই বাক্যে দুটি ক্রিয়াপদ রয়েছে– ‘খেয়ে’ ও ‘যাবো’। লক্ষ করলে দেখা যাচ্ছে ‘যাবো’ ক্রিয়াটি বলা মাত্রই আমরা একটি সম্পূর্ণ ভাব উপলব্ধি করতে পারছি। কিন্তু যদি বলা হয় “আমি ভাত খেয়ে” , তাহলে ক্রিয়া পদ থাকা সত্ত্বেও বাক্যের ভাবটি সম্পূর্ণ হচ্ছে না। অথচ যদি বলা হয় “আমি যাবো” তাহলেও অর্থ প্রকাশে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে ‘খেয়ে’ ক্রিয়াটি একক ভাবে বাক্যের ভাবকে সম্পূর্ণ করতে সক্ষম নয়। অপরদিকে ‘যাবো’ ক্রিয়াটি বাক্যের ভাবকে সম্পূর্ণ করতে সক্ষম।
সমাপিকা ক্রিয়া – কাকে বলে ও উদাহরণ
‘সমাপিকা’ শব্দটি এসেছে ‘সমাপক’ (যে সমাপন করে) শব্দের লিঙ্গপরিবর্তন করে। কারণ সংস্কৃতে ‘ক্রিয়া’ স্ত্রী-লিঙ্গ। সুতরাং সমাপিকা কথার অর্থ ‘যে শেষ করে বা সমাপ্ত করে’। নাম থেকেই এর সংজ্ঞা স্পষ্ট হয়ে যায়।
যে ক্রিয়া বাক্যের ভাবকে সম্পূর্ণ ভাবে প্রকাশ করতে পারে বা সমাপ্ত করতে পারে, তাকে সমাপিকা ক্রিয়া বলে।
সমাপিকা ক্রিয়া প্রতিটি বাক্যের প্রধান অংশ। এটিই বাক্যের মূল বিধেয়।
উদাহরণ : খেয়েছি, দেখব, আসছে, বললাম, খেলি, যাচ্ছি ইত্যাদি।
উপরের উদাহরণগুলিতে একটি মজার ব্যাপার আছে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, উদাহরণগুলিতে কর্তা উল্লেখ করা হয়নি অথচ কর্তা কোন পুরুষের, তা টের পাওয়া যাচ্ছে। তা ছাড়াও, ক্রিয়াটি সম্পাদনের কাল বা সময়ও বুঝতে পারা যাচ্ছে। এর কারণ একটাই : সমাপিকা ক্রিয়া মাত্রই কর্তার পুরুষ ও ক্রিয়ার কাল অনুসারে রূপ গ্রহণ করে। সমাপিকা ক্রিয়ার দেহের মধ্যেই কাল ও পুরুষের পরিচয় নিহিত থাকে।
অসমাপিকা
অসমাপিকা ক্রিয়া বলে।
অসমাপিকা ক্রিয়ার উদাহরণ : আমি ভাত খেয়ে এসেছি। (খেয়ে/খাইয়া)
সে খেলতে গেছে। (খেলতে/খেলিতে)
তুমি এলে আমি যাবো। (এলে/আসিলে)
মূল ধাতুর সাথে ‘ইয়া’, ‘ইতে’ , ‘ইলে’ প্রত্যয়** যোগে অসমাপিকা ক্রিয়া গঠিত হয়।
[** এগুলি প্রত্যয় না বিভক্তি এ নিয়ে একটুখানি মতভেদ আছে। কেউ কেউ এদের বিভক্তি বলেন। কিন্তু ভাষাগুরু সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক ড: রামেশ্বর শ’-র মত অনুসারে আমরা এদের প্রত্যয়ই বলব।]
অসমাপিকা ক্রিয়াগুলির প্রধান বৈশিষ্ট্য হল, এরা কাল ও পুরুষের পরিচয় বহন করে না। সব কালে ও সব পুরুষে এদের একই রূপ। যেমন : “আমি ভাত খেয়ে বিদ্যালয়ে যাব।” আবার : “তুমি ভাত খেয়ে বিদ্যালয়ে গিয়েছিলে।” উভয় বাক্যে পুরুষ ও কাল আলাদা হলেও ‘খেয়ে’ অসমাপিকাটি বদলায়নি।
সমাপিকা ও অসমাপিকা ক্রিয়ার উদাহরণ (একসাথে)
তুমি ডাকলে আমি যাবো। — ‘ডাকলে’ অসমাপিকা, ‘যাবো’ সমাপিকা।
খাবার খেয়ে বাইরে যাও। — ‘খেয়ে’ অসমাপিকা, ‘যাও’ সমাপিকা।
বল খেলতে মাঠে যাবো। — ‘খেলতে’ অসমাপিকা, ‘যাবো’ সমাপিকা।
কর্ম অনুসারে ক্রিয়ার প্রকারভেদ
প্রথমে জেনে নিই : কর্ম কাকে বলে ?
কর্ম হল ক্রিয়ার আশ্রয়। ক্রিয়ার কাজটি কর্মের উপরেই প্রযুক্ত হয়। ক্রিয়া সম্পাদিত হয়ে কর্মকেই প্রভাবিত বা পরিবর্তিত করে অথবা পরিপূর্ণ করে। কর্ম সবসময় বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ হয়। অবশ্য অনেক সময় একটি উপবাক্য বা বাক্যাংশও বিশেষ্যের ভূমিকা পালন করতে পারে। কর্মের সংজ্ঞা এইভাবে দেওয়া যায় : বাক্যের যে বিশেষ্য বা সর্বনাম পদ ক্রিয়ার আশ্রয়রূপে কাজ করে বা ক্রিয়ার কাজটি সরাসরি যার উপর প্রযুক্ত হয় ও যাকে প্রভাবিত করে, তাকে ক্রিয়ার কর্ম বলে।
“আমরা ভাত খাই।” বাক্যে খাওয়া কাজটি ভাতের উপর কাজ করছে। তাই ভাত কর্ম।
কর্ম খুঁজে পাওয়ার জন্য ক্রিয়াকে কর্তা সমেত** ‘কী’ বা ‘কাকে’ দিয়ে প্রশ্ন করতে হয়। উত্তরটি হয় ক্রিয়ার কর্ম। যেমন : রাম বই পড়ে— রাম কী পড়ে? উ: ‘বই’। ‘বই’ হল কর্ম।
[** কর্তা সমেত প্রশ্ন না করলেও চলে তবে তাতে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কর্তা যদি জড়বস্তু হয় তখন ‘কী’ প্রশ্নের উত্তরে কর্তাটিও চলে আসে। ফলে অকর্মক ক্রিয়াকেও সকর্মক মনে হয়। যেমন : নদী বইছে। এই বাক্যে “কী বইছে?” প্রশ্ন করলে উত্তর চলে আসে, “নদী” । কিন্তু নদী কর্ম নয়, কর্তা। এই সমস্যা দূর হবে , যদি আগে কর্তা খুঁজে নিয়ে কর্তা সমেত প্রশ্ন করি। যেমন : নদী কী বইছে? এই ক্ষেত্রে আর ভুল হবে না।]
সকর্মক ক্রিয়া – কাকে বলে ও উদাহরণ
কিছু ক্রিয়া আছে, যেগুলি কর্মের আশ্রয় ছাড়া সম্পাদিত হয় না ; সম্পাদিত হওয়ার জন্য কর্ম লাগবেই, তাদের সকর্মক ক্রিয়া বলে।
যেমন : “রাম পড়ছে।” এই বাক্যে ‘পড়ছে’ ক্রিয়াটি সম্পাদন করতে একটি পাঠ্য বিষয় দরকার। সেটা হতে পারে বই, কাগজ, পত্রিকা বা কোনো বিষয় (যেমন ভূগোল) ইত্যাদি। তাই ‘পড়ছে’ ক্রিয়াটি সকর্মক।
এরকম : দেখ্, শুন্, খা, দে ইত্যাদি ধাতু থেকে আগত ক্রিয়াগুলি সকর্মক ক্রিয়া।
বাক্যের মধ্যে কর্ম উল্লিখিত থাক বা না থাক, সকর্মক ক্রিয়া সবসময়ই সকর্মক।
সকর্মক ক্রিয়ার আবার ২টি উপবিভাগ আছে— এককর্মক ও দ্বিকর্মক।
এককর্মক ক্রিয়া – কাকে বলে
যে ক্রিয়াগুলির একটিমাত্র কর্ম, তাদের এককর্মক ক্রিয়া বলে।
যেমন : আমি বই পড়ি। রাম গান শুনছে। সে ছবি আঁকছে। তুমি বইটা কিনবে।
এই উদাহরণগুলিতে প্রতিটি ক্রিয়ার একটি করে কর্ম আছে। এককর্মক ক্রিয়ার ক্ষেত্রে ‘কী’ বা ‘কাকে’ প্রশ্নের মধ্যে একটি করা যাবে, অপরটি যাবে না।
দ্বিকর্মক ক্রিয়া – কাকে বলে
যে ক্রিয়ার দু’টি কর্ম থাকে, তাকে দ্বিকর্মক ক্রিয়া বলে।
একটি কথা মনে রাখতে হবে : একই ক্রিয়ার দু’টি কর্ম একই ধরণের হলে চলবে না। একটি হবে জড়বাচক ও অন্যটি হবে প্রাণিবাচক। যেমন: রাম আমাকে কলমটা দিয়েছে। এখানে ‘কলমটা’ এবং ‘আমাকে’, দুটোই কর্ম এবং দুটি দুরকম কর্ম। সুতরাং এটি দ্বিকর্মক ক্রিয়া। কিন্তু “আমি মাছ ও ভাত খাই।”– এই বাক্যে দুটি কর্ম (মাছ ও ভাত) থাকলেও ‘খাই’ ক্রিয়াটি দ্বিকর্মক ক্রিয়া নয়, কারণ এখানে দুটি কর্ম একই ধরনের। তাই দ্বিকর্মক ক্রিয়া হতে গেলে একই ক্রিয়ার অধীনস্থ দুটি কর্মের মধ্যে একটিকে মুখ্য কর্ম ও অপরটিকে গৌণ কর্ম হতে হবে, অথবা একটিকে উদ্দেশ্য কর্ম ও অপরটিকে বিধেয় কর্ম হতে হবে। বিভিন্ন প্রকার কর্ম সম্পর্কে জানতে কারক অধ্যায়টি পড়ে দেখুন।
দ্বিকর্মক ক্রিয়ার উদাহরণ
দ্বিকর্মক ক্রিয়ার উদাহরণ প্রচুর সংখ্যায় নেই। দ্বিকর্মক ক্রিয়ার কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া হলো। দুটি কর্ম আলাদা রঙে চিহ্নিত করা হয়েছে।
১: আমি তোমাকে কলমটা দিয়েছি।
২: আমি তোমাকে কথাটা বলবো।
৩: তিনি ধরাকে সরা মনে করেন।
ADVERTISEMENT
অকর্মক ক্রিয়া – কাকে বলে ও উদাহরণ
যে ক্রিয়াগুলি কর্ম ছাড়াই সম্পাদিত হয়, তাদের অকর্মক ক্রিয়া বলে।
অকর্মক ক্রিয়ার উদাহরণ
ছেলেটি ‘হাঁটছে‘। মেয়েটি ‘হাসছে‘। সবাই ‘ঘুমোচ্ছে‘। ইত্যাদি।
এই ক্রিয়াগুলি সম্পাদন করতে কর্ম লাগে না। তাই এদের অকর্মক ক্রিয়া বলে। অকর্মক ক্রিয়াকে কর্তা সহ ‘কী’ বা ‘কাকে’ দিয়ে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। যেমন : “ছেলেটি কী হাঁটছে?” এই প্রশ্নের কোনো উত্তর পাওয়া যায় না। তবে সমধাতুজ কর্মের সাহায্যে কখনও কখনও অকর্মক ক্রিয়কে সকর্মক করা হয়। এই বিষয়টি কারক অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে।
গঠন অনুসারে ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ
গঠন অনুসারে ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ বোঝার জন্য প্রথমে নিচের ভিডিওটি দেখুন ও তারপর নিচের আলোচনাটি পড়ুন।
প্রযোজক ক্রিয়া
প্রযোজক ধাতুতে উপযুক্ত প্রত্যয় বিভক্তি যোগ করে যে ক্রিয়া পাওয়া যায় তাকে প্রযোজক ক্রিয়া বলে। প্রযোজক ক্রিয়ার দ্বারা অন্যকে কাজ করানো বোঝায়।
অন্যকে কাজ করানোরও দু’টি রকমফের আছে। (ক) যে করাচ্ছে, সে সক্রিয় থেকে অন্যকে কাজ করাতে পারে । যেমন : “মাস্টারমশায় ছেলেদের পড়াচ্ছেন।” এখানে মাস্টারমশায় সক্রিয়। আবার (খ) “বাবু চাকরকে বাগান পরিষ্কার করাচ্ছেন।” এখানে বাবু নিষ্ক্রিয় প্রেরণাদাতা। কিন্তু এই দুটিই প্রযোজক ক্রিয়া।
প্রযোজক ক্রিয়ার উদাহরণ
সমাপিকা : খাওয়াচ্ছেন, দেখাল, শুনিয়েছে, বলাবো, হাসিয়েছে, কাঁদিও না, (সাধুরূপে পরিবর্তিত করে নিলে গঠন স্পষ্ট হবে।)
অসমাপিকা: শোনাতে, দেখিয়ে, বাঁচাতে, খাওয়ালে, পড়িয়ে, হাঁটাতে, ইত্যাদি।
ভাষাবিদ ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ √পাড়্ (যেমন ফল পাড়া বা কাউকে ফেলে দেওয়া অর্থে) এবং √মার্ (হত্যা করা, প্রহার নয়) প্রভৃতি ধাতুকেও প্রযোজক বলেছেন। ড: শহীদুল্লাহের উল্লিখিত এই ধাতুগুলি এবং এদের থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াগুলি সাধারণত প্রযোজক হিসেবে গণ্য হয় না, কিন্তু গণ্য করা উচিত। তবে এই ক্রিয়াগুলির গঠন কোন প্রত্যয় যোগে হয়, সে সম্পর্কে ড: শহীদুল্লাহ কিছু বলেন নি।
নামধাতুজ ক্রিয়া
নামধাতু থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াকে নামধাতুজ ক্রিয়া বলে। নামপদ বলতে বিশেষ্য, বিশেষণ পদ বুঝতে হবে। নামধাতু সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে ধাতু অধ্যায়টি পড়ে দেখুন ।
নামধাতুজ ক্রিয়ার উদাহরণ
চোরে আমার মানিব্যাগটা হাতিয়েছিল।
সবাই মিলে তাকে ঠেঙাল।
উত্তরিলা বিভীষণ। ছেলেটি ঘুমাচ্ছে। ইত্যাদি।
যৌগিক ক্রিয়া
প্রধান অর্থবাহী অসমাপিকা ক্রিয়া ও তার সাথে সহায়ক অপর একটি ক্রিয়ার যোগে যে ক্রিয়া গঠিত হয়, তাকে যৌগিক ক্রিয়া বলে।
অনেকেই মনে করেন যৌগিক ক্রিয়া গঠিত হয় একটি অসমাপিকা ক্রিয়া ও একটি সমাপিকা ক্রিয়ার যোগে। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ঠিক নয়। অসমাপিকার সাথে সমাপিকা এবং অসমাপিকা উভয় প্রকার ক্রিয়ার যোগেই যৌগিক ক্রিয়া গঠিত হয়। কিন্তু অসমাপিকার সাথে অসমাপিকার যোগে গঠিত যৌগিক ক্রিয়াগুলি বাংলা ব্যাকরণে এখনও পর্যন্ত অবহেলিত। যৌগিক ক্রিয়ার সংজ্ঞায় অসমাপিকা ও সমাপিকা ক্রিয়ার যোগের কথাই বলা হয়। আমরা উভয় প্রকার যৌগিক ক্রিয়ারই উদাহরণ দেখে নেব।
অসমাপিকা ও সমাপিকা যোগে যৌগিক ক্রিয়া :
খেয়ে ফেলল, দেখে ফেলেছে, শুয়ে পড়, এসে গেছে ইত্যাদি। লক্ষণীয় : প্রথম অসমাপিকাটির অর্থই প্রকাশিত হচ্ছে।
অসমাপিকা ও অসমাপিকা যোগে যৌগিক ক্রিয়া :
পড়ে গিয়ে হাত ভেঙেছে । ঘটনাটা দেখে ফেলে বিপদে পড়লাম। তুুমি এসে যেতেই জটিলতা বাড়ল। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লে ভোরে উঠতে পারবো। ইত্যাদি।
যুক্ত ক্রিয়া বা সংযোগমূলক ক্রিয়া
একটি বিশেষ্য বা বিশেষণের সাথে একটি ক্রিয়ার যোগে গঠিত ক্রিয়াকে যুক্ত ক্রিয়া বা সংযোগমূলক ক্রিয়া বলে। অন্যভাবে বলা যায় , যুক্ত ধাতু থেকে নিষ্পন্ন ক্রিয়াকে যুক্ত ক্রিয়া বলে। যুক্ত ক্রিয়া ভালো ভাবে বুঝতে নিচের ভিডিওটি দেখুন।
যুক্ত ক্রিয়ার উদাহরণ
ছেলেটি সাঁতার কাটছে। তোমার সাথে দেখা করব। ওকে আমি ঘৃণা করি। মা ছেলেকে ঘুম পাড়াচ্ছে। ( এখানে ঘুম পাড়াচ্ছে একটি যুক্ত প্রযোজক ক্রিয়া)।
মনে রাখা দরকার, একটি ক্রিয়া একই সঙ্গে যুক্ত আবার যৌগিক দুইই হতে পারে। যেমন
তুমি এর মধ্যেই রান্না করে ফেলেছো?
আমি আজকের মতো সাঁতার কেটে নিয়েছি। এই উদাহরণগুলিতে অসমাপিকা রূপে ব্যবহৃত হয়ছে একটি যুুক্ত ক্রিয়া।
যুক্ত ক্রিয়া চেনার উপায়:
যুক্ত ক্রিয়া চিনতে না পারলে একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করে সহজেই চিনে নেওয়া যায়। আমরা জানি যুক্ত ক্রিয়াতে দুটি অংশ থাকবে। প্রথমটি নামপদ হবে। দ্বিতীয়টি হবে ক্রিয়াপদ। দুটি মিলে একটি বিশেষ কাজ করা বোঝাবে। যেমন: সাঁতার কাটছি বললে কিছু কাটা বোঝায় না, সুইমিং বোঝায়। এখন নামপদটি (সাঁতার) তুলে নিলে পড়ে থাকবে ‘কাটছি’। এই ‘কাটছি’ ক্রিয়ার সাথে সুইমিং-এর কোনো সম্পর্ক নেই। অর্থাৎ ক্রিয়াটির অর্থ বদলে গেলো। এইভাবে যুক্ত ক্রিয়ার প্রথম অংশটি তুলে নিয়ে দেখতে হবে অর্থ বদলে গেল কিনা। বদলে গেলে বুঝতে হবে ক্রিয়াটি যুক্ত ক্রিয়া। বদলে না গেলে বুঝতে হবে যুক্ত ক্রিয়া নয়। যেমন: “আমি মাছ কাটছি” – এখানে ‘মাছ’ তুলে নিলেও কাটার কাজটি ঠিকঠাকই বোঝা যাচ্ছে। তাই ‘মাছ কাটছি’ যুক্ত ক্রিয়া নয়। ‘মাছ’ কর্ম কারক ও ‘কাটছি’ মৌলিক ক্রিয়া।
ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া
ধ্বন্যাত্মক ধাতু থেকে উৎপন্ন ক্রিয়াকে ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়া বলে। যেমন :
ফোঁড়াটা টনটনাচ্ছে। হাতটা কনকনাচ্ছে। কান কটকটাচ্ছে। লোকটা ধুঁকছে। বাঘটা রাগে ফুঁসছে। টনটন, কনকন, কটকট, ধুঁক, ফুঁস ইত্যাদি ধ্বন্যাত্মক শব্দ উক্ত ক্রিয়াগুলির মূলে আছে।
##এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভালো, অনেকে ধ্বন্যাত্মক ধাতুকে নামধাতুর অন্তর্ভুক্ত করতে চান। তাই ধ্বন্যাত্মক ক্রিয়াকেও স্বভাবত তাঁরা নামধাতুজ ক্রিয়ার অন্তর্ভুক্ত করেন।
পঙ্গু ক্রিয়া
যে ক্রিয়াকে সব কালে (অর্থাৎ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের সবকটি শ্রেণিবিভাগে) ব্যবহার করা যায় না, তাকে পঙ্গু ক্রিয়া বলে। বাংলায় কয়েকটি মাত্র পঙ্গু ক্রিয়া আছে, এদের সাধারণত একটিমাত্র কালেই (সাধারণ বর্তমান) ব্যবহার করা যায়। অন্যান্য কালে ব্যবহৃত হয় না বলেই এদের পঙ্গু ক্রিয়া বলে।
যেমন:
পঙ্গু ক্রিয়ার উদাহরণ
বটে, নয়, আছে প্রভৃতি ক্রিয়াগুলি পঙ্গু ক্রিয়া। ( “ছেলেটা বুদ্ধিমান বটে।” এই উদাহরণে ‘বটে’ ক্রিয়ার কাল বদলানো যায় না। অর্থাৎ, বটছে, বটবে, বটত ইত্যাদি রূপ পাওয়া যায় না। ‘নয়’-এর ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটে।)
পঙ্গু ক্রিয়া যে ধাতু থেকে নিষ্পন্ন হয় তাকে পঙ্গু ধাতু বলে। √বট্, √আছ্, √নহ্ এই তিনটি পঙ্গু ধাতু। √যা ধাতুকেও পঙ্গু বলা যায়, কারণ একেও অতীত কালের সব ভাগে ব্যবহার করা যায় না। অতীত কালে √যা এর বিকল্পে √গ ধাতু ব্যবহৃত হয়।
অকর্তৃক ক্রিয়া
কয়েকটি ক্রিয়া আছে যাদের কর্তা হয় না বা কর্তা নির্ণয় করা যায় না। তাদের অকর্তৃক ক্রিয়া বলে। যেমন: শীত করছে, লজ্জা লাগছে, খিদে পেয়েছে, মেঘ করেছে ইত্যাদি।
অনেক সময় সম্বন্ধ পদের বিভক্তি যোগে একটি কর্তাস্থানীয় পদ অকর্তৃক ক্রিয়ার সাথে থাকতে পারে। এদের কর্তা বলে মনে হয়। তাই এদের বলে প্রতীয়মান কর্তা। যেমন: আমার লজ্জা লাগছে। তোমার খিদে পেয়েছে? ইত্যাদি।
বাংলা ক্রিয়াপদ গঠনের নিয়ম
এই অনুচ্ছেদে আমরা বাংলা ক্রিয়াপদ গঠনের নিয়মগুলি অতি সংক্ষেপে আলোচনা করব। বাংলায় ক্রিয়াপদ গঠনের পদ্ধতি বোঝার জন্য সমাপিকা ও অসমাপিকা, এই দুই ক্রিয়ার গঠন বুঝে নিলেই হবে। ধাতুর সাথে ‘ইয়া’, ‘ইতে’ , ‘ইলে’ প্রত্যয় যোগে গঠিত হয় অসমাপিকা ক্রিয়া। অপর দিকে সমাপিকা ক্রিয়ার গঠনে বৈচিত্র্য অনেক বেশি। তার কারণ অসমাপিকা ক্রিয়া কাল ও পুরুষ নিরপেক্ষ কিন্তু সমাপিকার রূপ কাল ও পুরুষের উপর নির্ভর করে। তাই সমাপিকা ক্রিয়া গঠনের জন্য ক্রিয়াবিভক্তি এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রত্যয় ও সহায়ক ধাতুর(এগুলিকে বাংলার auxiliary verb বলা যেতে পারে) প্রয়োজন হয়। বাংলায় সহায়ক ধাতুগুলি হল, √আছ্, √থাক্ ও √লাগ্ । যেমন: পড়িতেছে= √পড়্+ইতে+√আছ্+এ। ভবিষ্যৎ কালের ক্ষেত্রে পড়িতে থাকিবে= √পড়্ + ইতে +√থাক্ +ইব + এ এখানে পড়্ মূল ধাতু এবং আছ্ সহায়ক ধাতু। সমাপিকা ক্রিয়ার শেষ অংশে থাকে কাল ও পুরুষবাচক ক্রিয়াবিভক্তি। এই বিষয়টি ক্রিয়ার কাল আলোচনাতে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
11 thoughts on “ক্রিয়া পদ | ক্রিয়াপদের শ্রেণিবিভাগ ও ধারণা”
সহজ ভাষায় এবং সহজভাবে পুরো বিষয়টা সহজে বোঝার মতো করে লিখা এবং ব্যাবহার উপযোগী।
খুব সুন্দর লিখেছেন Sir
Thank you.
খুব ভালো।👌👌💐💐🎂
ছেলেটি গোল্লায় গেছে। কোন ক্রিয়া?
খুব ভালো স্যার।
অসাধারন লাগলো পড়ে।
খুব সুন্দর স্যার। আপনার বিচক্ষণ লিখনির ভূয়সী প্রশংসা করতে হয়। ধন্যবাদ স্যার।
খুব সুন্দর স্যার। আপনার বিচক্ষণ লিখনির ভূয়সী প্রশংসা করতে হয়। ধন্যবাদ স্যার।
যুক্তক্রিয়ায় যত টুকু বুঝতে অসুবিধা ছিল আজ clear হয়ে গেলো.. Thank you sir
তদ্ধিত প্রত্যয় এর আলোচনার
তদ্ধিত প্রত্যয়ের আলোচনার লিংকটা একটু দিলে ভালো হয়।