Ananyabangla.com

ঝাড়খণ্ডি উপভাষা: বাকঁড়ি

বাঁকড়ি-ঝাড়খণ্ডি উপভাষার সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা

দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্যিক বিভাস রায়চৌধুরীর একটি গল্প বা উপন্যাসে পড়েছিলাম গল্পের একটি চরিত্র বাঁকুড়ার রাণীবাঁধ অঞ্চলের কথ্য উপভাষাটির মাধুর্যে নিজের মুগ্ধতা প্রকাশ করছে। বলা বাহুল্য এই মুগ্ধতা আসলে সাহিত্যিকের নিজের‌ই‌। ওখানে লেখক যে উপভাষাটির কথা বলেছেন সেটি আসলে বাঁকড়ি উপভাষা। বাঁকুড়ার পূর্ব ও উত্তর ভাগ বাদ দিয়ে সমগ্র জেলা এমনকি জেলা সদরেও এই উপভাষাটিই চলে। বাঁকুড়ার এই অঞ্চলের মানুষ আজ‌ও মাতৃভাষা বিসর্জন দিয়ে মান্য বাংলাকে কথোপকথনের কাজে ব্যবহার করা শুরু করেনি।   

Advertisement


আমরা জানি, বিস্তীর্ণ ভূখণ্ড জুড়ে প্রচলিত কোনো ভাষার আঞ্চলিক রূপভেদগুলিকে বলে উপভাষা। উপভাষা কোনো আলাদা ভাষা নয়, দুটি উপভাষার মধ্যে উচ্চারণগত ও গঠনগত পার্থক্য থাকলেও তা এতটা বেশি নয় যে তাদের আলাদা ভাষা রূপে গণ্য করতে হবে। এখন মজার ব্যাপার হল একটি উপভাষাও যদি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে প্রচলিত থাকে তাহলে এলাকাভেদে একটি তার মধ্যেও অনেক পার্থক্য দেখা যায়। যেমন, বর্ধমান ও হাওড়া, উভয় জেলার উপভাষা রাঢ়ি হলেও দুই জেলার মৌখিক ভাষায় অল্পবিস্তর ফারাক দেখা যায়। এইভাবে উপভাষার মধ্যেও ক্ষুদ্র উপভাষার অস্তিত্ব চোখে পড়ে। এমন‌ই একটি উপভাষার মধ্যবর্তী উপভাষার নাম ‘বাঁকড়ি’। বাঁকড়ি আসলে ঝাড়খণ্ডি উপভাষার একটি বিভাগ। ঝাড়খণ্ডির অন্য বিভাগের মধ্যে আছে পুরুলিয়া তথা মানভূমের ভাষা ও ঝাড়খণ্ডের (ঝাড়খণ্ডের পূর্বভাগ) ঝাড়খণ্ডি। এই শেষ ভাগটি বেশ আলাদা। বহুদিন ধরে এতে হিন্দির মিশ্রণ‌ও ঘটেছে অনেকখানি। এ ছাড়া বিষ্ণুপুর সংলগ্ন অঞ্চলের উপভাষাটির‌ও যথেষ্ট স্বাতন্ত্র্য রয়েছে। এতে মিশ্রণ ঘটেছে রাঢ়ির।


হয়তো অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অঞ্চলের উপভাষা হ‌ওয়ার কারণে ঝাড়খণ্ডি উপভাষা সম্পর্কে ভাষাতাত্ত্বিক ও ছাত্রছাত্রীদের কৌতুহল একটু কম। অন্যান্য ছোটো ছোটো উপভাষার মতোই বাঁকড়ি সম্পর্কেও বাঁকুড়ার বাইরের মানুষের ধারণা খুব সীমিত। আজকের আলোচনায় বাঁকড়ির ভিত্তিতে ঝাড়খণ্ডি উপভাষার ধ্বনিতাত্ত্বিক ও রূপতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্যের কিছু আলোচনা করবো। 


এই প্রসঙ্গে প্রথমেই যা বলা দরকার, তা হল, বাঁকড়ি উপভাষায় বাংলা ভাষার মূল শব্দবিভক্তি, ক্রিয়াবিভক্তি, প্রত্যয় প্রভৃতি যথাসম্ভব অবিকৃত অবস্থায় রয়েছে। অর্থাৎ, উচ্চারণের দিক থেকে দেখতে গেলে বাঁকড়ির উচ্চারণে মূলগত উচ্চারণকে যতটা সম্ভব অবিকল রাখা হয়েছে। যেমন, সাধারণ বর্তমান কালে মধ্যম পুরুষের সমাপিকা ক্রিয়ার পুরুষ বিভক্তি যে ‘ও’ নয়, ‘অ’, তা বাঁকড়িতেই বোঝা যায়। “তুমি বলো” , “তুমি দ্যাখো” এগুলিকে বাঁকড়িতে বলা হয় “তুমি দ্যাখ(দ্যাখ্+অ)”, “তুমি বল”(বল্+অ)। এই ‘অ’ বিভক্তি‌ই রাঢ়ি ও বঙ্গালিতে ‘ও’ হয়ে গেছে।


য-ফলার প্রকৃত উচ্চারণ মান্য বাংলা অর্থাৎ রাঢ়িতে নেই। বাঁকড়িতে য-ফলাকে উচ্চারণ করা হয় প্রকৃত য-ফলা রূপেই। উদাহরণ: ‘সামান্য’ শব্দটিকে মান্য বাংলায় ‘সামান্নো’ উচ্চারণ করা হয়। বাঁকড়িতে উচ্চারণ হয় ‘সামাইন্-নিয়’ (সামাইন্-নিও’ নয় এবং ই দুটিই ক্ষীণতা-প্রাপ্ত)। 


বাংলা ধ্বনিতত্ত্বে অপিনিহিতি ও অভিশ্রুতির পরিচিত যে উদাহরণগুলি দেওয়া হয়ে থাকে (যেমন: দেখিয়া>দেইখ্যা>দেখে), সেখানে পরিবর্তনের একটি স্তরকে উপেক্ষা করা হয়েছে অথবা কেউ খবর পাননি। ঐ মধ্যবর্তী স্তরটি বাঁকড়িতে উপস্থিত। ‘দেইখ্যা’ ও ‘দেখে’-র মাঝে রয়েছে ‘দেখ্যে’ , অর্থাৎ পুরো বিবর্তনটি হলো : দেখিয়া>দেইখ্যা>দেখ্যে>দেখে। শেষ স্তরে য-ফলা লুপ্ত হয়ে ‘দেখে’ হয়েছে। এই দিক থেকে দেখলে বাঁকড়ি-ঝাড়খণ্ডিকে বঙ্গালি ও রাঢ়ির মধ্যবর্তী একটি উপভাষা বলা যায় কিনা তা ভেবে দেখার অবকাশ রয়েছে। 


সর্বনামের দিক থেকেও বাঁকড়ি-ঝাড়খণ্ডি অনেকটাই মূলানুগ। যেমন: মান্য বাংলায় ‘ও’ সর্বনামটি ‘উহা’ থেকে এসেছে। বাঁকড়িতে সর্বনামটির রূপ হয়েছে ‘উ’। ‘উহার’ হয়েছে ‘উয়ার’, ‘উহাকে’ হয়েছে ‘উয়াকে’। বাংলা প্রত্যয়গুলির ক্ষেত্রেও এক‌ই কথা খাটে। বাঁকড়িতে বাংলা তদ্ধিতের মূল রূপটি খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন ‘উয়া’ প্রত্যয়টি মান্য বাংলায় বদলে গেছে। গাছ+উয়া থেকে হয়েছে গেছো। বাঁকড়িতে গাছ+উয়া গাছুয়া-ই হয়। শুধু উ-টি ক্ষীণ হয়ে যায়।

বাংলা সাধু ভাষার গঠনের সাথে বাঁকড়ি ঝাড়খণ্ডির আশ্চর্য মিল খুঁজে পাওয়া যায়, বিশেষত ক্রিয়াপদের গঠনে। যেমন: দেখিয়াছ>দেইখ্যাছ, বলিয়াছ>ব‌ইল্যাছ (ছো নয়)। ভবিষ্যৎ কালের প্রথম পুরুষের সমাপিকা ক্রিয়ার গঠনে বাঁকড়ি-ঝাড়খণ্ডির একটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আছে। বিদ্যাসাগরীয় সাধু ভাষার ‘করিবেক’, ‘বলিবেক’ প্রভৃতি ক্রিয়াগুলি এই উপভাষায় প্রায় অবিকৃত রূপেই উচ্চারণ করা হয়। শুধু ‘ই’-টি অপিনিহিত হয় ও ক্ষীণতা প্রাপ্ত হয়। যেমন: ক‌ইরব্যাক, ব‌ইলব্যাক প্রভৃতি। এ থেকে আমরা খুব সহজেই সিদ্ধান্তে আসতে পারি যে বাংলা সাধু গদ্যের মূল কাঠামোটি আদপে কৃত্রিম নয়, বাংলার কথ্য ভাষার কাঠামো অবলম্বনেই গড়ে উঠেছিল। যাঁরা সাধু গদ্যকে কৃত্রিম মনে করেন তাঁরা বাংলার কথ্য উপভাষাগুলির ধ্বনিতত্ত্ব ও রূপতত্ত্ব সম্যক জানেন না। কারণ, এমনটা কোনোমতেই সম্ভব নয় যে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি হ‌ওয়া সাধু ভাষা থেকে এই অঞ্চলের মানুষের কথ্য ভাষার জন্ম হয়েছে। বরং নিশ্চিত ভাবে উল্টোটিই ঘটেছে। এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে বঙ্গালি উপভাষার সাথেও সাধু বাংলার বহু সাদৃশ্য রয়েছে। 


বাঁকড়ির সাথে সাধু বাংলার এই সাদৃশ্য বাংলা ভাষাতত্ত্বের চর্চার পক্ষে খুব‌ই সহায়ক। যখন‌ই কোনো শব্দ, ক্রিয়া, বিভক্তি, প্রত্যয় ইত্যাদির মূল রূপ নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে তখন আমি মাতৃভাষা বাঁকড়ির শরণাপন্ন হয়েছি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সমাধান‌ও পেয়েছি। তবে একটি কথা মনে রাখতে হবে যে এখানে আলোচিত বাঁকড়ির বৈশিষ্ট্যগুলি মূলত ঝাড়খণ্ডি উপভাষার‌ই বৈশিষ্ট্য। ঝাড়খণ্ডির অন্য শাখাগুলিতেও এই বৈশিষ্ট্যগুলি প্রায় এক‌ই রকম ভাবেই রয়েছে। 


এই ব্লগের সমস্ত লেখা পড়ার জন্য সূচিপত্রে যান

BLOG AD HERE

1 thought on “ঝাড়খণ্ডি উপভাষা: বাকঁড়ি”

  1. Pingback: রাষ্ট্রভাষা কাকে বলে - Ananyabangla.com

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *