বাচ্য পরিবর্তন করার নিয়ম
ইতিমধ্যে বাচ্য সম্পর্কে দুটি পোস্টে আলোচনা করেছি। একটি হল বাচ্যের বিস্তারিত আলোচনা এবং অন্যটি হল বাচ্য চেনার নিয়ম। এ বার আলোচনা করবো বাচ্য পরিবর্তন করার নিয়ম ও বাচ্য পরিবর্তনের উদাহরণ। প্রথমেই চলুন দেখে নিই কীভাবে কোনো বাক্যকে এক বাচ্য থেকে অন্য বাচ্যে রূপান্তরিত করা যায়।
কর্তৃবাচ্য থেকে কর্মবাচ্য (পরিবর্তন)
১: প্রথমেই দেখে নিতে হবে বাক্যটিতে কর্ম আছে কিনা। কর্ম না থাকলে কর্মবাচ্য করা যাবে না, ভাববাচ্য করতে হবে। যেমন “ছেলেটি সকালবেলা হাঁটতে বেরিয়েছে।” এই বাক্যে কর্ম নেই। তাই এর কর্মবাচ্য হবে না।
২: বাক্যের মধ্যে কর্ম থাকলে কর্মটিকে বাক্যের উদ্দেশ্য স্থানে বা কর্তার স্থানে নিয়ে আসতে হবে, কর্মে বিভক্তি থাকলে সেটি তুলে কর্মের বিভক্তি শূন্য করতে হবে। যেমন: “ক্ষিপ্ত জনতা লোকটিকে প্রহার করেছে।” লোকটি এই বাক্যের কর্ম, তাই কর্মবাচ্য করার জন্য ‘লোকটি’-কে বাক্যের উদ্দেশ্য স্থানে আনতে হবে। কর্মবাচ্যের রূপটি হবে: “লোকটি জনতার দ্বারা প্রহৃত হয়েছে।”
— এখানে ‘লোকটি’ বাক্যের গোড়ায় চলে এসেছে ও বাক্যের উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে এবং লোকটির বিভক্তি শূন্য হয়েছে।
৩: প্রকৃত কর্তায় দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক প্রভৃতি করণ কারকের অনুসর্গগুলি যুক্ত হবে। কর্তাকে করণ বলে মনে হবে। যেমন: পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হল।
৪: ক্রিয়াটিকে ক্রিয়াবাচক বা ক্রিয়াজাত বিশেষণে রূপান্তরিত করতে হবে। যেমন: গ্রহণ > গৃহীত, প্রহার > প্রহৃত, প্রদান > প্রদত্ত প্রভৃতি। তবে এ ছাড়া ‘খাওয়া’, ‘দেওয়া’ , ‘নেওয়া’, ‘বলা’, প্রভৃতি ‘আ’-প্রত্যয়ান্ত পদও বিশেষণ রূপে কাজ করতে পারে। ক্রিয়াবাচক বিশেষণ কী, তা না জানা থাকলে এই ব্লগের ক্রিয়াজাত বিশেষণ পদের আলোচনাটি পড়ে বিস্তারিত জেনে নিন।
৫: ঐ বিশেষণের সঙ্গে হ ধাতুর ক্রিয়া যোগে কর্ম বাচ্যের সমাপিকা ক্রিয়া গঠন করতে হবে।
৬: সমাপিকা ক্রিয়ার পুরুষ হবে কর্মের পুরুষ অনুসারে। অর্থাৎ কর্ম যদি উত্তম পুরুষ হয়, তবে ক্রিয়াও উত্তম পুরুষ হবে, কর্ম যদি মধ্যম পুরুষ হয়, তবে ক্রিয়াও মধ্যম পুরুষ হবে। যেমন: ২ নং নিয়মের উদাহরণে ‘লোকটি’-র পরিবর্তে ‘আমি’ কর্ম হলে কর্মবাচ্যের রূপ হত : “আমি জনতার দ্বারা প্রহৃত হয়েছি।”
কর্তৃবাচ্য থেকে ভাববাচ্যে পরিবর্তন
১: কর্তায় কে অথবা র/এর বিভক্তি যোগ করতে হবে। যেমন: “আমি স্কুলে যাবো।” > “আমাকে স্কুলে যেতে হবে।” অথবা “আমার স্কুলে যাওয়া হবে।”
২: বাক্যের ক্রিয়াপদটিকে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য পদে পরিণত করতে হবে অথবা ‘ইতে’/’তে’ যোগে অসমাপিকা ক্রিয়া পদে পরিণত করতে হবে। যেমন: “আমার স্কুলে যাওয়া হবে।” / “আমাকে স্কুলে যেতে হবে।” ‘যাওয়া’ ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য, ‘যেতে’ অসমাপিকা। (ক্রিয়াবাচক বিশেষ্য সম্পর্কে জানতে বিশেষ্য পদের আলোচনাটি পড়ুন।)
৩: বাক্যে কর্ম থাকলে কর্মটিকে হয় ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের সাথে যুক্ত করে দিতে হবে, অথবা কর্মে ‘কে’ বিভক্তি যুক্ত করে দিতে হবে। যেমন: “আমি বলটা ফেলে দিলাম।” > “আমার বলটাকে ফেলে দেওয়া হল।” এখানে ‘বল’ কর্মে ‘কে’ বিভক্তি দিয়ে দিলাম। আবার: আমি ভাত খেয়েছি। > আমার ভাত-খাওয়া হয়েছে। এখানে হাইফেন দিয়ে ‘ভাত’ কর্মকে ক্রিয়াবাচক বিশেষ্যের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। এই দুটিই ভাববাচ্য।
কর্মবাচ্য থেকে ভাববাচ্য পরিবর্তন
কর্মবাচ্য থেকে ভাববাচ্য সাধারণত করতে হয় না। তবু আমরা পদ্ধতি জেনে রাখবো, তাহলে বাচ্য বুঝতে সুবিধা হবে।
১: কর্মের প্রাধান্য দূর করতে হবে। বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়া কর্মকে অনুসরণ করবে না, তার বদলে সব সময় প্রথম পুরুষকে অনুসরণ করবে।
২: যদি দেখা যায় কর্তৃবাচ্যে কর্মে বিভক্তি ছিলো, কর্মবাচ্যে লুপ্ত হয়েছে, তাহলে ভাববাচ্য করার সময় লুপ্ত বিভক্তিটি ফিরিয়ে আনতে হবে।
যেমন: কর্তৃবাচ্য: পুলিশ চোরকে ধরল। –বিভক্তি আছে।
কর্মবাচ্য: পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হল। — বিভক্তি লুপ্ত।
ভাববাচ্য: পুলিশের চোরকে ধরা হল। — বিভক্তি ফিরে এল।
৩: কর্তায় দ্বারা, দিয়া, কর্তৃক প্রভৃতি অনুসর্গ থাকলে অধিকাংশ সময় সেগুলি তুলে তার বদলে ‘কে’ বা ‘র-এর’ বিভক্তি জুড়তে হবে। যেমন: “পুলিশ কর্তৃক চোর ধৃত হল।” > “পুলিশের চোরকে ধরা হল।” কোনো কোনো সময় ভাববাচ্যেও কর্তার সাথে ‘দ্বারা’ যোগ করা হয়। যেমন: “আমার দ্বারা যাওয়া হবে না।” এখানে লক্ষ করুন ‘যাওয়া’ অকর্মক এবং অকর্মক ক্রিয়ার কর্মবাচ্য হয় না, যেমন ভাবেই হোক ভাববাচ্যই হয়।
কর্ম বা ভাব বাচ্য থেকে কর্তৃ বাচ্যে রূপান্তর
কর্ম বা ভাব বাচ্য থেকে কর্তৃ বাচ্যে রূপান্তরিত করার জন্য কর্তাকে প্রাধান্য দিতে হবে। ক্রিয়াকে এমন রূপ দিতে হবে, যাতে সরাসরি বোঝা যায় যে কর্তাই কাজটা করছে। যেমন: “আমার যাওয়া হবে।” > “আমি যাবো।” ‘যাওয়া হবে’ বললে মনে হচ্ছে ‘যাওয়াটা’ নিজেই হবে, কিন্তু ‘যাবো’ বললে বোঝা যাচ্ছে যে কাজটি আমিই করবো। আবার “রাবণ রাম কর্তৃক নিহত হন।” বললে মনে হচ্ছে রাবণই নিহত হবার কাজটা করেছেন, কিন্তু আসলে রাম তাঁকে বধ করেন। যদি বলা হয় “রাম রাবণকে বধ করেন।” তাহলে মনে হচ্ছে রাম কাজটা করেছেন।
বাচ্য পরিবর্তনের উদাহরণ
১: বইটি আমি আগেই পড়েছি। (কর্মবাচ্যে রূপান্তরিত করো)
উত্তর: বইটি আমার দ্বারা আগেই পড়া হয়েছে।
২: তুমি আমাকে অপমান করেছো। (কর্মবাচ্যে )
উত্তর: আমি তোমার দ্বারা অপমানিত হয়েছি।
৩: সে কি সত্যিই আর আসবে? (ভাববাচ্যে)
উত্তর: তার কি সত্যিই আর আসা হবে?
৪: তুমি পড়বে। (ভাববাচ্যে)
উত্তর: তোমাকে পড়তে হবে।
৫: এখানে কিছু পাওয়া যায় না। (কর্তৃ বাচ্যে)
উত্তর: এখানে কিছু পাই না/পাবেন না/পাবে না।
৬: তুমি কি এখন খাবে? (ভাববাচ্যে)
উত্তর: তোমার কি এখন খাওয়া হবে?
৭: কোথায় গিয়েছিলে? (ভাববাচ্যে)
উত্তর: কোথায় যাওয়া হয়েছিলো?
৮: সে তোমাকে প্রতারণা করেছে। (কর্মবাচ্যে)
উত্তর: তুমি তার দ্বারা প্রতারিত হয়েছ।
৯: রাবণ রাম কর্তৃক নিহত হন। (কর্তৃবাচ্যে)
উত্তর: রাম রাবণকে বধ করেন।
১০: রাম রাবণকে বধ করেন। (ভাব বাচ্যে)
উত্তর: রামের রাবণকে বধ করা হয়।
বাচ্য থেকে প্রশ্নোত্তর
১: “আমাকে পড়তে হচ্ছে।” বাক্যটি কোন বাচ্য?
উত্তর: এটি ভাব বাচ্য।
২: “কোথায় থাকা হয়?” কোন বাচ্য?
উত্তর: এটি ভাব বাচ্য।
৩: কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া কাকে অনুসরণ করে?
উত্তর: কর্তৃবাচ্যের ক্রিয়া কর্তাকে অনুসরণ করে।
৪: কোন বাচ্যের রূপান্তর সম্ভব নয়?
উত্তর: কর্মকর্তৃবাচ্যের রূপান্তর সম্ভব নয়।
৫: “আমার যাওয়া হবে না।” এটি কোন বাচ্য?
উত্তর: এটি ভাব বাচ্য।
৬: “কাজটা ভালো দেখায় না।” কোন বাচ্যের উদাহরণ?
উত্তর: কর্ম বাচ্যের উদাহরণ।
৭: “সুতি কাপড় অনেক দিন টেকে।” বাক্যটি কোন বাচ্যের উদাহরণ?
উত্তর: এটি কর্তৃ বাচ্যের উদাহরণ। কেউ কেউ এটিকে কর্মকর্তৃবাচ্য বলে ভুল করেন, কিন্তু ‘টেকে’ ক্রিয়াটির উপর কাপড়ের অধিকার নিয়ে কোনো সংশয় নেই। কাপড় নিজেই টেকে, সেটাই তার ধর্ম। এখানে অন্য কর্তার অস্তিত্ব নেই। কাপড়ের ব্যবহারকারী এখানে কোনো কাজ করছে না।
৮: “তোমাকে হাঁটতে হবে।” এটি কোন বাচ্যের উদাহরণ?
উত্তর: এটি ভাব বাচ্যের উদাহরণ।
৯: বাঁশি বাঝে ঐ মধুর লগনে। এটি কোন বাচ্যের উদাহরণ?
উত্তর: এটি কর্মকর্তৃবাচ্যের উদাহরণ। কেউ কেউ অবশ্য এগুলিকে কর্তৃবাচ্য বলে চিহ্নিত করতে চেয়েছেন।
১০: “জল পড়ে, পাতা নড়ে।” কোন বাচ্য?
উত্তর: কর্তৃবাচ্য। জল বা পাতা এখানে কর্ম নয়। জল বা পাতা এখানে কর্তা। কারণ জল নিজেই পড়ে, প্রকৃতির নিয়মে। পাতাও প্রকৃতির নিয়মে নড়ে। অনেকে বলেন হাওয়া পাতাকে নড়াচ্ছে, তাই হাওয়া আসল কর্তা। এই যুক্তি মানলে “শিশুটি জন্মগ্রহণ করল।” এই বাক্যে শিশু কর্তা নয়, কারণ তার বাবা মা তাকে জন্ম দিয়েছে; আবার “সূর্য উঠল।” বাক্যে সূর্য কর্তা নয়, কারণ পৃথিবী ঘুরছে বলেই সূর্য উঠছে। কর্তা নির্ণয় করার সময় প্রকৃতির নিয়মকে কর্তা হিসেবে দেখলে চলে না, এ সব ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর্তাকেই কর্তা ধরতে হয়।
১১: তার যেন আসা হয়। এটি কোন বাচ্যের উদাহরণ?
উত্তর: এটি ভাব বাচ্যের উদাহরণ।
বাচ্য পরিবর্তন অনুশীলন
নিচের বাক্যগুলির নির্দেশ অনুযায়ী বাচ্য পরিবর্তন করো।
১: তুমি কি সকালে উঠেছো? (ভাববাচ্যে)
২: তারা আজ স্কুলে যাবে না। (ভাববাচ্যে)
৩: আমি তোমার দ্বারা একটি কলম প্রদত্ত হয়েছি। (কর্তৃবাচ্যে)
৪: ওখানে আমি কম অপমানিত হইনি। (ভাববাচ্যে)
৫: আমার সব টাকা খরচ হয়ে যায়। (কর্তৃবাচ্যে)
৬: ভাতটা নামাও। (ভাববাচ্যে)
৭: গণেশ সুভাষকে একটা ছবি দেখাচ্ছে। (কর্মবাচ্যে)
৮: কথা বলার জন্য বাংলা ব্যবহার করি। (কর্মবাচ্যে)
৯: তিনি পুঁথি পাঠ করেন। (কর্মবাচ্যে)
১০: একটা আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। (কর্তৃবাচ্যে)
এই ব্লগে আরও কী কী আছে জানতে সূচিপত্র দেখুন।
বাংলা ব্যাকরণের সেরা বই সম্পর্কে জানুন।