ধ্বনি পরিবর্তন কী
ভাষায় ব্যবহৃত ধ্বনিগুলি চিরকাল এক রকম থাকে না। এ বৈশিষ্ট্য প্রতিটি ভাষারই নিজস্ব ধর্ম। ভাষা চলমান, ভাষা বিবর্তনশীল, ভাষা প্রাণময়। ভাষার প্রাথমিক উপাদান ধ্বনি, তাই ধ্বনিও স্বাভাবিক ভাবেই বিবর্তনশীল। সময়ের সাথে সাথে ভাষায় ব্যবহৃত বিভিন্ন শব্দের এক বা একাধিক ধ্বনি বদলে যেতে থাকে। এই ঘটনাকে ব্যাকরণের পরিভাষায় ধ্বনি পরিবর্তন বলে। ধ্বনি পরিবর্তন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবু আমাদের অনুসন্ধান করে দেখা উচিত ধ্বনির এই বিবর্তন কেন হয়, কেনই বা এই বিবর্তন স্বাভাবিক। আসুন জেনে নিই ধ্বনি পরিবর্তনের প্রধান কারণগুলি। আপনি এই সঙ্গে ধ্বনি পরিবর্তনের ধারাগুলি পড়ে নিতে পারেন।
ধ্বনি পরিবর্তনের কারণ
উচ্চারণের সুবিধা
ধ্বনি পরিবর্তনের সবচেয়ে বড়ো কারণ হলো উচ্চারণের সুবিধা। আমাদের বাগ্যন্ত্র স্বভাবতই শ্রমবিমুখ। যখনই কোনও ধ্বনিকে উচ্চারণ করতে অপেক্ষাকৃত বেশি পরিশ্রম হয়, তখনই আমাদের বাগ্যন্ত্র সেই ধ্বনিকে সম্ভব হলে এমন ভাবে বদলে নেয়, যাতে উচ্চারণের শ্রম লাঘব হয়। যেমন একটি উদাহরণ দিই: ‘দেশি’ শব্দটিতে দুটি স্বর আছে: ‘এ’ এবং ‘ই’। এই স্বর দুটির উচ্চারণ স্থান ভিন্ন। তাই এই শব্দটি উচ্চারণ করতে জিহ্বাকে দুটি ভিন্ন স্থানে যেতে হয়, কিন্তু এই শব্দটিকে বদলে নিয়ে ‘দিশি’ উচ্চারণ করলে একটি স্থানেই দুটি স্বর উচ্চারিত হয়।
শোনার ভুল
শোনার ভুলের কারণে অনেক সময় ধ্বনি পরিবর্তন ঘটতে পারে। একটি ধ্বনির উচ্চারণ ক্ষীণ হয়ে এলে সেই ধ্বনিটি আর ভালো করে শোনা যায় না। ফলে এক সময় দেখা যায় ওই ধ্বনিটি লোপ পেয়েছে।
উচ্চারণের ত্রুটি
অপরিশীলিত উচ্চারণের কারণে অনেক কঠিন শব্দের উচ্চারণে ত্রুটি ঘটে। অধিকাংশ অর্ধতৎসম শব্দে ধ্বনির যে বিকার দেখা যায়, তা এই উচ্চারণের ত্রুটির কারণে ঘটেছে।
অন্য ভাষার প্রভাব
অন্য ভাষার প্রভাবে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটতে পারে। দুটি ভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ পাশাপাশি বাস করলে উভয় ভাষার উচ্চারণ রীতি উভয় ভাষাতেই কম বেশি গৃহীত হয়। ফলে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে।
সন্নিহিত ধ্বনির প্রভাব
একটি নিকটবর্তী ধ্বনির প্রভাবে পূর্ববর্তী বা পরবর্তী ধ্বনির পরিবর্তন ঘটতে পারে। স্বরসঙ্গতি, সমীভবন, ঘোষীভবন, মহাপ্রাণীভবন প্রভৃতি পরিবর্তন প্রায়শ পাশাপাশি ধ্বনির প্রভাবেই সংঘটিত হয়।
লিপিবিভ্রাট
এক ভাষার শব্দ অন্য ভাষার লিপিতে লিখতে গিয়ে অনেক সময়ই উচ্চারণ বদলে যায়। যেমন বাঙালি পদবী বাঁড়ুজ্যে ইংরেজিতে হয়েছে ব্যানার্জি।
বাগ্যন্ত্রের ত্রুটি বা অক্ষমতা
জিহ্বার জড়তা, তোতলামি প্রভৃতি ত্রুটির কারণেও ধ্বনির পরিবর্তন ঘটতে পারে। ভিন্ন ভাষার শব্দ অন্য ভাষাভাষী লোকেরা উচ্চারণ করতে পারে না। এই ভাবেও ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। যেমন: ফরাসী শব্দ ‘রেস্তোরাঁ’ বাঙালির উচ্চারণে অধিকাংশ সময় ‘রেস্টুরেন্ট’ হয়ে যায়।
দ্রুত উচ্চারণ
দ্রুত উচ্চারণ করতে গেলে অনেক সময় ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। এক্ষেত্রে সাধারণত ধ্বনির লোপ ঘটে বা সমীভবন ঘটে। যেমন: কোথা যাবে > কোজ্জাবে, মাস্টারমশাই > ‘মাস্টামশাই’।
অজ্ঞতা
সঠিক বানান না জানার ফলে অনেক সময় আমরা ভুল উচ্চারণ করে থাকি। যেমন: ফর্ম > ফ্রম বা ব্যাজ > ব্যাচ। এইভাবেও ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে।
ছন্দের প্রয়োজনে
ছন্দের প্রয়োজনে অনেক সময় ধ্বনি পরিবর্তন হয়, আমরা সবাই দেখেছি। স্বরভক্তির অনেক উদাহরণ বিশেষ ভাবে ছন্দের খাতিরেই ঘটে। যেমন: ভক্ত > ভকত, কর্ম > করম।
সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা
বড় কথাকে ছোটো করে বলার একটা চেষ্টা আমাদের সব সময় থাকে। তাই অনেক সময় আমরা সংক্ষেপকরণ করি। ফলে ধ্বনির পরিবর্তন ঘটে। যেমন: ল.সা.গু.।
অচেনা শব্দকে চেনা শব্দের রূপ দেওয়া
আমরা অনেক সময় অচেনা বিদেশি শব্দকে চেনা শদের রূপ দিয়ে উচ্চারণ করি। এর ফলে যে ধ্বনি পরিবর্তন হয় ,তাকে লোকনিরুক্তি বলে। যেমন: আর্ম চেয়ার > আরাম চেয়ার।
আরও পড়ুন