মূলধ্বনি ও সহধ্বনির ধারণা
ধ্বনির আলোচনায় আমরা অবিভাজ্য ও বিভাজ্য ধ্বনির কথা পড়েছি। বিভাজ্য ধ্বনির দুটি ভাগ স্বর ও ব্যঞ্জনের কথা পড়েছি। এই পোস্টে আমরা ধ্বনির অন্য একটি বিষয় সম্পর্কে জানবো: মূল ধ্বনি ও সহধ্বনি। এই বিষয়টি পশ্চিমবঙ্গ উচ্চমাধ্যমিকের পাঠক্রমে আলোচিত হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে মূলধ্বনি ও সহধ্বনির বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
মূলধ্বনি বা স্বনিম কাকে বলে?
এক কথায় বলতে গেলে কোনো নির্দিষ্ট ভাষার (যেমন ইংরেজি বা বাংলা) কোনো একটি শব্দের যে কোনো একটিমাত্র ধ্বনি বদলে দিয়ে তার জায়গায় অন্য একটি ধ্বনি বসিয়ে দিলে যদি শব্দটির অর্থ বদলে যায় তাহলে যে দুটি ধ্বনির অদলবদল ঘটানো হল, সেই দুটি ধ্বনিই ঐ নির্দিষ্ট ভাষার মূল ধ্বনি রূপে গণ্য হবে। এর অপর নাম ধ্বনিমূল বা স্বনিম।
আমরা একটি শব্দ নিলাম ‘যখন’। এই শব্দটির ধ্বনি বিশ্লেষণ করলে পাবো
য্+অ+খ্+অ+ন্ (ধ্বনিবিশ্লেষণে শেষের অ বাদ গেছে)
এই ধ্বনিগুচ্ছের মধ্যে থেকে প্রথম ধ্বনি য্-কে বদলে দিয়ে তার জায়গায় আমরা ত্ ধ্বনি বসিয়ে দিলে নতুন অর্থবিশিষ্ট শব্দ পাচ্ছি: ‘তখন’। তার মানে য্ ও ত্ বাংলা ভাষার দুটি মূল ধ্বনি হিসেবে গণ্য হবে।
ন্যূনতম শব্দজোড়
ন্যূনতম শব্দজোড় বলতে বোঝায় ন্যূনতম (অর্থাৎ একটিমাত্র) ধ্বনির পার্থক্যবিশিষ্ট একজোড়া শব্দ।
উপরের উদাহরণে যে দুটি শব্দ আমরা নিয়েছি (যখন ও তখন) একটি ন্যূনতম শব্দজোড়। মনে রাখতে হবে একটি শব্দজোড় মানে দুটি শব্দ।
একটি ধ্বনি মূলধ্বনি হবে কিনা তা যাচাই করতে এই ন্যূনতম শব্দজোড়কে কাজে লাগানো হয়। এ ছাড়া এর অন্য কোনো ব্যবহার নেই। উপরের উদাহরণে আমরা দুটি ব্যঞ্জনকে বাংলা ভাষার মূল ধ্বনি হিসেবে চিহ্নিত করেছি। একই ভাবে অন্য কোনো জোড়ের সাহায্য নিয়ে আমরা দুটি স্বরকেও মূল ধ্বনি হিসেবে চিহ্নিত করতে পারবো।
যেমন: ‘দিন’ ও ‘দান’ শব্দজোড়কে ভাঙলে আমরা বুঝতে পারবো ই এবং আ, এই দুটি স্বরধ্বনি বাংলা ভাষার দুটি মূল ধ্বনি।
মূল ধ্বনিকে ভাষাতত্ত্বের রীতি অনুযায়ী দুটি স্ল্যাশ চিহ্নের মাঝে রেখে দেখানো হয়। অর্থাৎ /ক্/ লেখা দেখলে বুঝতে হবে ক্ মূল ধ্বনির কথা বলা হচ্ছে।
সহধ্বনি কাকে বলে?
সহধ্বনির ধারণাটি অপেক্ষাকৃত একটু জটিল। একটি মূল ধ্বনির একাধিক উচ্চারণ-বৈচিত্র্য থাকলে প্রত্যেকটি বৈচিত্র্য-কে বলা হবে ঐ মূল ধ্বনির সহধ্বনি।
কিন্তু ভাষার মধ্যে একই মূল ধ্বনির এমন বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয় কেন? এর কারণ হলো বিভিন্ন শব্দের মধ্যে একটি ধ্বনিকে পাশাপাশি অবস্থিত আরও অন্যান্য ধ্বনির সঙ্গে উচ্চারিত হতে হয়। আমাদের জীবনযাত্রায় যেমন পাড়াপ্রতিবেশীর প্রভাবে নানা ধরনের অ্যাডজাস্টমেন্ট করতে হয়, ঠিক তেমনি ভাবে ধ্বনিকেও অনেক সময় প্রতিবেশী ধ্বনির প্রভাবে নিজেকে কিছুটা বদলে নিতে হয়। তাই ‘উল্টো’ শব্দের ল্ যে স্থানে উচ্চারিত হয়, ‘লঙ্কা’ শব্দের ল্ ঠিক সেই জায়গায় উচ্চারিত হয় না। গবেষণায় দেখা গেছে বাংলা ভাষার ল্ ধ্বনি তিনটি জায়গায় উচ্চারিত হতে পারে: মূর্ধা, তালু ও দন্তমূল। ‘উল্টো’ শব্দে মূর্ধায়, ‘লক্ষ’ শব্দে তালুতে ও ‘লিলুয়া’ শব্দে দন্তমূলে ল্ উচ্চারিত হচ্ছে। এই তিনটি ল্ আলাদা মূল ধ্বনি নয়, এরা হলো ল্ মূল ধ্বনির সহধ্বনি। তাহলে প্রশ্ন আসবে, মূল ধ্বনি ল্ কোথায় উচ্চারিত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর হবে: কোথাও না। ভাষায় আমরা সহধ্বনিকেই উচ্চারণ করি, মূল ধ্বনি একটি ধারণা। বলা যেতে পারে তিনটি ল্ সহধ্বনি মিলে যে ধ্বনিপরিবার তৈরি হলো, সেই পরিবারটিই /ল্/ মূলধ্বনি। তবে সহধ্বনিগুলি বিভিন্ন স্থানে উচ্চারিত হলেও যে সহধ্বনিটি ভাষায় সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়, তার স্থানকেই মূল ধ্বনির উচ্চারণ স্থান ধরা হয়। এই স্থানটিকে আমরা ঐ মূল ধ্বনির স্বাভাবিক উচ্চারণ স্থান বলতে পারি।
সহধ্বনি সম্পর্কে একটি কথা মনে রাখতে হবে: একটি সহধ্বনি কখনও অন্য সহধ্বনির স্থানে উচ্চারিত হয় না। এই ব্যাপারকে বলে পরিপূরক অবস্থান।
সহধ্বনিকে তৃতীয় বন্ধনীর মধ্যে লিখতে হয়। স্বাভাবিক উচ্চারণ স্থানের সহধ্বনিকে [ল্] – এইভাবে লেখা হয়। যে সহধ্বনির উচ্চারণ অল্পবিস্তর এগিয়ে আসে তাকে [ল্ →] এইভাবে সামনে তির চিহ্ন দিয়ে এবং যার উচ্চারণ পিছিয়ে যায় তাকে [← ল্ ] এইভাবে লিখতে হবে।
আমাকে YouTube-এ ফলো করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
আরও পড়ুন
3 thoughts on “মূলধ্বনি বা ধ্বনিমূল ও সহধ্বনি | স্বনিম কাকে বলে”
এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।
সহজ সরল প্রাঞ্জল ভাষায় লেখা।
সুন্দর বিশ্লেষণ।