সন্ধির ধারণা ও স্বরসন্ধি কাকে বলে
সন্ধির সংজ্ঞা ও ধারণা
‘সন্ধি’ কথাটির সাধারণ অর্থ হ’ল, মিলন, জোড়, গাঁট বা Joint. ব্যাকরণেও সন্ধি বলতে যা বোঝানো হয়, তার সাথে সন্ধি শব্দের সাধারণ অর্থের মিল আছে। আমরা যে সব ধ্বনি উচ্চারণ করি, সেগুলি সাধারণত একা একা উচ্চারিত হয় না। বেশিরভাগ সময় একাধিক ধ্বনি পর পর উচ্চারণ করতে হয়। তবেই আমরা মনের একটি ভাব প্রকাশ করতে পারি। যেমন, “শরৎ চলে এসেছে” কথাটা বলার জন্য আমাদের শ্,অ,র্,অ,ৎ, চ্,অ,ল্,এ, এ,স্,এ,ছ্,এ- এতগুলো ধ্বনি পর পর উচ্চারণ করতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, এখানে আমরা জানি যে, আমরা ৩টে আলাদা আলাদা পদ উচ্চারণ করছি। কিন্তু আমাদের বাগ্-যন্ত্র অতশত বোঝে না। বাগ্-যন্ত্র তার নিজের নিয়মে শুধু পর পর ধ্বনিগুলি উচ্চারণ করার কাজটি করতে থাকে। তার কাছে পুরো ব্যাপারটা একটা যান্ত্রিক প্রক্রিয়া। এইরকম যান্ত্রিক ভাবে উচ্চারণ করার সময় পাশাপাশি দুটি শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে বাগ্-যন্ত্র অনেক সময় একটি শব্দের শেষ ধ্বনির সাথে পরের শব্দের প্রথম ধ্বনিটিকে জুড়ে ফেলে। যেমন : “শরৎ চলে এসেছে” বলতে গিয়ে বাগ্-যন্ত্র বলে ফেলে, “শরচ্চলেএসেছে”। ‘শরৎ’-এর ৎ আর ‘চলে’-র চ্ একসাথে মিশে যায় এবং মিশে গিয়ে ‘চ্চ’ হয়ে যায়। এই ঘটনাটাই সন্ধি। সন্ধি কোনো মানুষের মাথা খাটিয়ে তৈরি করা ব্যাপার নয়। সন্ধি আমাদের বাধ্যবাধকতা। আমাদের বাগ্-যন্ত্র এটা করে ফেলে; না করে থাকতে পারে না। এই প্রসঙ্গে সন্ধি ও সমাসের সাদৃশ্য ও পার্থক্য রচনাটিও পড়ে নিন।
তার মানে আমরা দেখলাম, দুটো পৃথক শব্দ (বা পদ) পাশাপাশি উচ্চারিত হওয়ার সময় একটার শেষে আর অপরটার গোড়ায় অবস্থিত দুটো ধ্বনি মিশে যায়। এর ফলে কখনও তাদের মধ্যে একটা বদলে যায়, কখনও দুটোই বদলে যায় আবার কখনও দুটোয় মিলেমিশে একটা নতুন ধ্বনি তৈরি করে। এই ঘটনাকে সন্ধি বলে।
কিন্তু কথা হচ্ছে, সন্ধির সংজ্ঞা বলতে গিয়ে কি আমরা এত বড় করে বলবো? ব্যাকরণ এমনিতেই লোকে পড়তে চায় না। তার উপর বড় বড় সংজ্ঞা লেখাতে গেলে ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা আরও বেশি ভয় পেয়ে যাবে। ধারণাটি স্পষ্ট করার জন্যই এতটা বড় করে বলা। সন্ধি কাকে বলে, এই প্রশ্নের উত্তরে নিচের সংজ্ঞাটি নির্ভুল ও মোটামুটি পূর্ণাঙ্গ।
সন্ধি কাকে বলে?
পাশাপাশি উচ্চারিত দুটি শব্দের (বা শব্দাংশের) মধ্যে প্রথমটির শেষ ধ্বনি ও পরেরটির প্রথম ধ্বনির মিলনকে সন্ধি বলে।
সন্ধির ব্যাখ্যা
সন্ধিবিচ্ছেদ করলে আমরা দেখতে পাই দুটি শব্দকে যোগ করা হয়েছে। কিন্তু আসলে যুক্ত হয় প্রথম শব্দের শেষ ধ্বনির সাথে দ্বিতীয় শব্দের প্রথম ধ্বনিটি।
হিম+আলয় = হিমালয়। এই সন্ধিটি বর্ণবিশ্লেষণ করে দেখলে ব্যাপারটি স্পষ্ট হবে।
হ্+ই+ম্+ অ + আ +ল্+অ+য়্+অ ।
উপরের রেখাঙ্কিত স্বর দুটি যুক্ত হচ্ছে। বাকি ধ্বনিগুলো সন্ধিতে কোনো ভূমিকা পালন করে না, তাদের কোনো পরিবর্তনও হয় না। ‘হিমালয়’ শব্দটি ভাঙলে দেখা যাবে ঐ দুটি স্বর মিলিত হয়ে ‘আ’ হয়ে গেছে এবং বাকি ধ্বনিগুলি যেমন ছিল তেমনি আছে।
হ্+ই+ম্+আ+ল্+অ+য়্+অ।
স্বরসন্ধি কাকে বলে
স্বরধ্বনির সাথে স্বরধ্বনির মিলনকে স্বরসন্ধি বলে।
অর্থাৎ, স্বরসন্ধিতে অংশগ্রহণকারী ধ্বনিগুলির দুটিকেই স্বর হতে হবে। হিম+আলয়=হিমালয়, এটি একটি স্বরসন্ধির উদাহরণ।
স্বরসন্ধির সূত্র
সূত্র ১: অ/আ + অ/আ = আ
অ বা আ-এর সঙ্গে অ বা আ যুক্ত হলে দুয়ে মিলে আ হয়।
অর্থাৎ সন্ধিতে অংশগ্রহণকারী ধ্বনি দুটির মধ্যে প্রথমটি অ বা আ হতে হবে এবং দ্বিতীয়টিও অ বা আ হতে হবে।
উদাহরণ : হিম+অচল = হিমাচল
বর্ণ বিশ্লেষণ করে দেখি :
হ্+ই+ম্+অ + অ+চ্+অ+ল্+অ
= হ্+ই+ম্+আ+চ্+অ+ল্+অ ।
এখানে দেখা যাচ্ছে, হিম শব্দের শেষে অবস্থিত অ এবং অচল শব্দের প্রথমে অবস্থিত অ যুক্ত হয়ে আ হয়েছে।
অন্যান্য উদাহরণ :
বিন্ধ্য + অচল = বিন্ধ্যাচল
মোহ + অন্ধ = মোহান্ধ
মহা + আকাশ = মহাকাশ
তুষার + আবৃত = তুষারাবৃত
প্রেম + আস্পদ = প্রেমাস্পদ
নিত্য + আনন্দ = নিত্যানন্দ
চিত্র + অর্পিত = চিত্রার্পিত
সর্বস্ব + অন্ত = সর্বস্বান্ত
সর্বস্ব + অন্ত = সর্বস্বান্ত
গৃহ + অভ্যন্তর = গৃহাভ্যন্তর
সূত্র ২ : ই/ঈ+ই/ঈ = ঈ
ই বা ঈ-এর সঙ্গে ই বা ঈ যুক্ত হ’লে দুয়ে মিলে ঈ হয়।
এই সূত্রটি অনেকটা আগের সূত্রটির মতোই। দুটি একই ধরণের স্বর যুক্ত হয়ে একটি দীর্ঘস্বর সৃষ্টি করছে।
উদাহরণ:
রবি+ইন্দ্র= রবীন্দ্র (ই+ই=ঈ)
গিরি+ঈশ= গিরীশ (ই+ঈ=ঈ)-অর্থ হিমালয়, গিরিরাজ।
সতী+ঈশ= সতীশ (ঈ+ঈ=ঈ)-অর্থ সতীনাথ শিব।
সতী+ইন্দ্র = সতীন্দ্র (ঈ+ই =ঈ)
পরি+ঈক্ষা = পরীক্ষা
অভি+ঈক্ষা= অভীক্ষা
মণি+ইন্দ্র = মণীন্দ্র
প্রতি+ঈক্ষা = প্রতীক্ষা
প্রতি+ঈক্ষা = প্রতীক্ষা
সূত্র ৩ : উ/ঊ+উ/ঊ = ঊ
উ বা ঊ-এর সাথে উ বা ঊ যুক্ত হ’লে দুয়ে মিলে ঊ হয়।
এই সূত্রটিও আগের দুটি সূত্রের মতো।
উদাহরণ:
কটু + উক্তি = কটূক্তি
ভূ + ঊর্ধ্ব = ভূর্ধ্ব
বধূ + উৎসব = বধূৎসব
লঘু + ঊর্মি = লঘূর্মি
সূত্র ৪ : অ/আ + ই/ঈ = এ
অ বা আ-এর সাথে ই বা ঈ যুক্ত হ’লে দুয়ে মিলে এ হয়।
উদাহরণ :
গণ + ইন্দ্র = গণেন্দ্র (অ+ই)
মহা + ইন্দ্র = মহেন্দ্র (আ+ই)
গণ + ঈশ = গণেশ (অ+ঈ)
মহা + ঈশ = মহেশ (আ+ঈ)
দীন+ঈশ = দীনেশ (অর্থ: গরীবের ঈশ্বর)
দিন+ঈশ = দিনেশ (অর্থ: সূর্য)
নব + ইন্দু = নবেন্দু (নবীন চন্দ্র)
গগন + ইন্দ্র = গগনেন্দ্র
সত্য + ইন্দ্র = সত্যেন্দ্র
সূত্র ৫ : অ/আ + উ/ঊ = ও
অ বা আ-এর সঙ্গে উ বা ঊ যুক্ত হলে দুয়ে মিলে ও হয়।
উদাহরণ :
পর + উপকার = পরোপকার
কাল + ঊর্ধ্ব = কালোর্ধ্ব
কথা + উপকথন = কথোপকথন
চল + ঊর্মি = চলোর্মি
কাল+উত্তীর্ণ = কালোত্তীর্ণ
শুভ্র+উজ্জ্বল = শুভ্রোজ্জ্বল
উপর+উক্ত = উপরোক্ত
কাল+উত্তীর্ণ = কালোত্তীর্ণ
শুভ্র+উজ্জ্বল = শুভ্রোজ্জ্বল
উপর+উক্ত = উপরোক্ত
সূত্র ৬ : অ/আ + ঋ = অর্
অ বা আ-এর সঙ্গে ঋ যুক্ত হলে দুয়ে মিলে অর্ হয়।
উদাহরণ :
উত্তম + ঋণ = উত্তমর্ণ
একটু ভেঙে দেখি কী ভাবে ‘অর্’ আসছে :
উত্তমর্ণ = উ+ত্+ত্+অ+ম্+অ+র্+ণ্+অ।
ম-এর শেষে যে ‘অ’ আছে তার সাথে ‘ঋ’ যুক্ত হয়ে ‘অর্’ (স্থূলাক্ষর) হয়েছে।
অধম + ঋণ = অধমর্ণ
মহা + ঋষি = মহর্ষি (আ+ঋ=অর্)। লক্ষ করার বিষয় : আ-এর সাথে ঋ যুক্ত হলেও ‘অর’-ই আসছে।
ব্যতিক্রম : ঋ ধ্বনিটি ‘ঋত’ শব্দের ঋ হলে ‘অর্’ না হয়ে ‘আর্’ হয়। যেমন :
শীত + ঋত = শীতার্ত
ক্ষুধা + ঋত = ক্ষুধার্ত
বেদনা + ঋত = বেদনার্ত
সূত্র ৭ : অ/আ + এ/ঐ = ঐ
অ বা আ-এর সঙ্গে এ বা ঐ যুক্ত হলে দুয়ে মিলে ঐ হয়।
উদাহরণ :
জন + এক = জনৈক
মহা + ঐশ্বর্য = মহৈশ্বর্য
সূত্র ৮ : অ/আ + ও/ঔ = ঔ
অ বা আ-এর সাথে ও বা ঔ যুক্ত হলে দুয়ে মিলে ঔ হয়।
উদাহরণ :
মহা + ওষধি = মহৌষধি
পরম + ঔষধ = পরমৌষধ
বন + ওষধি = বনৌষধি
সূত্র ৯ : ই/ঈ + অন্য স্বর = ই/ঈ > য-ফলা
ই বা ঈ-এর সাথে ই বা ঈ ব্যতীত অন্য স্বর যুক্ত হলে ই বা ঈ য-ফলায় পরিণত হয় এবং পরবর্তী স্বরটি য-ফলায় যুক্ত হয়।
অর্থাৎ,
ই/ঈ + অ = য-ফলা
ই/ঈ + আ = য-ফলায় আ-কার
ই/ঈ + উ = য-ফলায় উ-কার
ই/ঈ + ঊ = য-ফলায় ঊ-কার
ই/ঈ + এ = য-ফলায় এ-কার
ই/ঈ + ও = য-ফলায় ও-কার
উদাহরণ :
বি+আহত = ব্যাহত
প্রতি+আশা = প্রত্যাশা
প্রতি + এক = প্রত্যেক
প্রতি+আশা = প্রত্যাশা
প্রতি + এক = প্রত্যেক
প্রতি + আদেশ = প্রত্যাদেশ
প্রতি + ঊষ = প্রত্যূষ
আদি + অন্ত = আদ্যন্ত
অধি + আদেশ = অধ্যাদেশ
নদী + অম্বু = নদ্যম্বু
পরি + অন্ত = পর্যন্ত ( এখানে র্-টি রেফ্ হচ্ছে এবং য-ফলা না হয়ে য্ হচ্ছে। একই ব্যাপার।)
সূত্র ১০ : উ/ঊ + অন্য স্বর = উ/ঊ > ব-ফলা
উ বা ঊ-র সাথে উ বা ঊ ছাড়া অন্য স্বর যুক্ত হলে উ বা ঊ ব-ফলায় (অন্তঃস্থ ব) পরিণত হয় এবং পরবর্তী স্বরটি ব-ফলায় যুক্ত হয়।
এই সূত্রটি অনেকটা আগের সূত্রটির মতই।
উদাহরণ :
মনু + অন্তর = মন্বন্তর
অনু + এষণ = অন্বেষণ
মনু + আদি = মন্বাদি
সু + আগত = স্বাগত
অনু + অয় = অন্বয়
সূত্র ১১ : ঋ + অন্য স্বর = ঋ> র(র-ফলা)
ঋ-এর সাথে অন্য স্বর যুক্ত হলে ঋ র-তে পরিণত হয়। র র-ফলা রূপে পূর্ববর্তী ব্যঞ্জনে যুক্ত হয় এবং পরবর্তী স্বরটি র-ফলায় যুক্ত হয়।
উদাহরণ :
পিতৃ + আদেশ = পিত্রাদেশ
পিতৃ + আলয় = পিত্রালয়
মাতৃ + ইচ্ছা = মাত্রিচ্ছা
সূত্র ১২ : এ + অন্য স্বর = এ> অয়্ ; ঐ + অন্য স্বর = ঐ> আয়্ ; ও + অন্য স্বর = ও> অব্ ; ঔ + অন্য স্বর = ঔ> আব্
এ, ঐ, ও, ঔ এই চারটি স্বরের সাথে স্বরধ্বনি যুক্ত হলে এ, ঐ, ও, ঔ যথাক্রমে অয়্, আয়্, অব্ এবং আব্ হয় ।
উদাহরণ :
নে + অন = নয়ন
এই উদাহরণটি বর্ণ বিশ্লেষণ করে দেখা যাক :
ন্+এ + অ+ন্+অ = ন্+অ+য়্+অ+ন্+অ
স্থূল বর্ণগুলি দেখলেই বোঝা যাবে, ‘এ’ থেকে ‘অয়্’ হয়েছে। বাকি স্বরগুলির কোনো পরিবর্তন হয়নি।
অন্য উদাহরণ :
গৈ + অক = গায়ক
নৈ + অক = নায়ক
গো + আদি = গবাদি ( গবাদি মানে, গোরু ইত্যাদি)
নৌ + ইক = নাবিক
পো + ইত্র = পবিত্র
ব্যতিক্রম/ নিপাতনে সিদ্ধ : গো + অক্ষ = গবাক্ষ (সূত্রানুসারে গবক্ষ)
আরও কয়েকটি নিপাতনে সিদ্ধ স্বরসন্ধি :
শুদ্ধ+ওদন = শুদ্ধোদন
কুল+অটা = কুলটা
শার+অঙ্গ = শারঙ্গ
মার্ত+অণ্ড = মার্তণ্ড
প্র+ঊঢ় = প্রৌঢ়
আরও কয়েকটি নিপাতনে সিদ্ধ স্বরসন্ধি :
শুদ্ধ+ওদন = শুদ্ধোদন
কুল+অটা = কুলটা
শার+অঙ্গ = শারঙ্গ
মার্ত+অণ্ড = মার্তণ্ড
প্র+ঊঢ় = প্রৌঢ়
Posted by- Ananya Pathak
আমাকে YouTube-এ ফলো করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
আরও পড়ুন
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ড: সত্যজিৎ মাইতি, M.A. (Sanskrit), M. Phil. , Ph.D.
4 thoughts on “সন্ধি এবং স্বরসন্ধির সূত্র, উদাহরণ ও ব্যতিক্রম”
অসাধারণ রে
😁
খুব ভালো
Pingback: অযোগবাহ বর্ণ কাকে বলে - Ananyabangla.com