বাক্য কাকে বলে
কয়েকটি পদ নির্দিষ্ট নিয়মে সজ্জিত হয়ে একটি ভাবকে পূর্ণ রূপে প্রকাশ করলে তাকে বাক্য বলে। তবে কথোপকথন বা বাক্যপরম্পরার ক্ষেত্রে একটি পদেও বাক্য হতে পারে। যেমন:
রঞ্জন: তুমি কি আমার সাথে যাবে?
সুকান্ত: যাবো।
এখানে রঞ্জন একটি পূর্ণ বাক্য ব্যবহার করলেও সুকান্ত একটি মাত্র পদের সাহায্যেই মনের ভাব প্রকাশ করেছে। এক্ষেত্রে এই ‘যাবো’ পদটিকে একটি বাক্য বলতে হবে।
উদ্দেশ্য ও বিধেয়, উদ্দেশ্যের প্রসারক ও বিধেয়ের প্রসারক
বাক্যের দুটি অংশ থাকে: উদ্দেশ্য ও বিধেয়। বাক্যে যার সম্পর্কে কিছু বলা হয়, তাকে উদ্দেশ্য বলে এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে যা বলা হয়, তাকে বিধেয় বলে।
বাক্যের সমাপিকা ক্রিয়াটি উদ্দেশ্যের পুরুষ ও ক্রিয়ার কাল অনুযায়ী গঠিত হয়।
যেমন: আমি সকালবেলা ফুটবল খেলি। — এই বাক্যে উদ্দেশ্য ‘আমি’, বিধেয় ‘সকালবেলা ফুটবল খেলি’। সমাপিকা ক্রিয়া ‘খেলি’ গঠিত হয়েছে উদ্দেশ্য ‘আমি’-র পুরুষ অর্থাৎ উত্তম পুরুষ ও বর্তমান কাল অনুসারে। এক্ষেত্রে একটি কথা মনে রাখতে হবে, উদ্দেশ্য ও বিধেয়ের মূল পদ একটি করেই থাকে। এদের সাথে প্রসারক পদ যুক্ত হয়ে বাক্যকে বড়ো করতে পারে। যে পদগুলি উদ্দেশ্যকে প্রসারিত করে, তারা উদ্দেশ্যের প্রসারক বা সম্প্রসারক ও যে পদগুলি বিধেয়কে প্রসারিত করে তাদের বিধেয়ের প্রসারক বা সম্প্রসারক বলে।
আমাদের পাড়ার ছেলেটি প্রতিদিন সকালে বই পড়়ে।
উপরের বাক্যে চিহ্নিত অংশগুলি যথাক্রমে উদ্দেশ্যের প্রসারক ও বিধেয়ের প্রসারক। ‘ছেলেটি’ উদ্দেশ্যের মূল পদ এবং ‘পড়ে’ বিধেয়ের মূল পদ। এদের মূল উদ্দেশ্য ও মূল বিধেয় বলা চলে। তবে মনে রাখতে হবে, প্রসারকগুলি উদ্দেশ্য ও বিধেয়েরই অংশ। তাই ‘আমাদের পাড়ার ছেলেটি’ — এই পুরো অংশটিকে একত্রে উদ্দেশ্যই বলতে হবে।
আরও পড়ুন: কারক
বাক্য গঠনের ত্রিশর্ত: আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও আসত্তি
বাক্য গঠন করার জন্য একগুচ্ছ পদকে পাশাপাশি সাজিয়ে দিলেই হয় না, বাক্য গঠনের জন্য পদগুলিকে কয়েকটি নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে সাজাতে হয়। এই নিয়মগুলিকে বলে বাক্য গঠনের শর্ত। বাক্য গঠনের শর্ত তিনটি। যোগ্যতা, আকাঙ্ক্ষা ও আসত্তি(আসক্তি নয়)।
যোগ্যতা
বাক্যে প্রকাশিত ভাবটি বাস্তবের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হবে। অর্থাৎ অসঙ্গত ভাব প্রকাশ করবে না। বাক্য গঠনের এই শর্তকে যোগ্যতা বলে।
যেমন: গোরু আকাশে ওড়ে। মাছ গাছে থাকে। ইত্যাদি পদগুচ্ছগুলি বাক্যের মতো মনে হলেও এগুলি যোগ্যতা পূরণ করতে পারেনি বলে বাক্য হয়ে ওঠেনি।
আকাঙ্ক্ষা
বাক্যে বক্তার মনের ভাব পূর্ণ রূপে প্রকাশ পাবে। শ্রোতার মনে আরও কিছু শোনার আকাঙ্ক্ষা থাকবে না। বাক্য গঠনের এই শর্তকে আকাঙ্ক্ষা বলে।
যেমন: “আমি সকালে উঠে” এইটুকু বললে শ্রোতার মনে শোনার ইচ্ছে পূরণ হয় না। প্রশ্ন জাগে “সকালে উঠে কী করে?”
তাই এই পদগুচ্ছ আকাঙ্ক্ষা পূরণে ব্যর্থ, ফলে বাক্য নয়।
আসত্তি
বাক্যের পদগুলি নিজেদের সম্পর্কের ভিত্তিতে যথাযথ স্থানে সন্নিবেশিত হবে। এই শর্তকে আসত্তি বলে।
যেমন: গোরু মাঠে রাখাল যায় সকালে নিয়ে। — এই পদগুচ্ছ আসত্তি দোষে দুষ্ট। সঠিক বাক্যটি হবে: রাখাল গোরু নিয়ে সকালে মাঠে যায়। ‘সকালে’ পদটি প্রথমে দিলেও চলবে।
বাক্যের গঠনগত শ্রেণীবিভাগ
গঠনের ভিত্তিতে বাক্য চার প্রকার। সরল, যৌগিক, জটিল ও মিশ্র। আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় যদিও জটিল ও মিশ্র বাক্যকে অভিন্ন বলেছেন। পশ্চিমবঙ্গ মধ্যশিক্ষা পর্ষদ মিশ্র বাক্যকে আলাদা বাক্য রূপে পাঠক্রমে রেখেছেন। আমাদের মতে মিশ্র বাক্যকে আলাদা শ্রেণীভুক্ত করাই উচিত।
সরল বাক্য
যে বাক্যে একটিমাত্র উদ্দেশ্য ও একটিমাত্র বিধেয় থাকে, তাকে সরল বাক্য বলে। সহজ ভাবে বলা চলে, যে বাক্যে একটিমাত্র সমাপিকা ক্রিয়া থাকে তাকে সরল বাক্য বলে।
যেমন: আমি প্রতিদিন ব্যায়াম করি। তোমরা সবাই ভালো করে পড়াশোনা করো। ছেলেরা এখন বাড়ি ফিরে খেলা দেখতে বসবে।
এগুলি সবই সরল বাক্য। বাক্যগুলিতে একটি করে সমাপিকা ক্রিয়া আছে।
যৌগিক বাক্য
একাধিক সরল বাক্য স্বাধীন ভাবে যুক্ত হয়ে যে বাক্য গঠন করে তাকে যৌগিক বাক্য বলে।
যেমন: রাম আসবে, তুমি যাবে। আমরা ভাত খাবো, তারপর বেরোবো। রবি আসেনি, তাই আমার যাওয়া হবে না। অনেক পড়ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। বড়োরা সুযোগ পেলো অথচ ছোটোরা পেলো না। আমি যাবো না, তুমি যাবে না, কেউই যাবে না।
এই বাক্যগুলিতে একাধিক সরল বাক্য স্বাধীন ভাবে রয়েছে।
জটিল বাক্য
জটিল বাক্যে একটি প্রধান বাক্য (একে প্রধান খণ্ডবাক্য বলে) এবং তার উপর নির্ভরশীল এক বা একাধিক অপ্রধান বাক্য (অপ্রধান খণ্ডবাক্য) থাকবে।
যেমন: আমি জানতাম তুমি আসবে।
যারা গিয়েছে তারা আর ফেরেনি।
যদি তুমি যাও তাহলেই আমি যাবো।
উপরের তিনটি বাক্যে দাগ দেওয়া অংশগুলি প্রধান খণ্ডবাক্য। দাগ না দেওয়া অংশটি অপ্রধান খণ্ডবাক্য। প্রধান খণ্ডবাক্য ও অপ্রধান খণ্ডবাক্য চেনার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পরবর্তী পোস্টে করবো। প্রধান খণ্ডবাক্য চেনার উপায়ও একই সঙ্গে আলোচনা করবো। পরবর্তী পোস্টে যাওয়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
প্রধান খণ্ডবাক্য ও অপ্রধান খণ্ডবাক্য চেনার জন্য নিচের ভিডিওটি দেখুন।
আমাকে YouTube-এ ফলো করার জন্য এখানে ক্লিক করুন।
মিশ্র বাক্য
মিশ্র বাক্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে অনেকেই বলেছেন দুটি ভিন্ন ধরনের বাক্য মিলে যে বাক্য গঠন করে তাকে মিশ্র বাক্য বলে। এই সংজ্ঞাটি সম্পূর্ণ ভুল নয়, আবার নির্ভুলও নয়। মিশ্র বাক্য গঠনের জন্য দুটি ভিন্ন ধরনের বাক্য লাগে, এ কথা ঠিক, কিন্তু মনে রাখতে হবে, মিশ্র বাক্যে কমপক্ষে একটি অপ্রধান খণ্ডবাক্য থাকতে হবে। একটি সরল ও একটি যৌগিক বাক্যকে সমুচ্চয়ী অব্যয় দিয়ে জুড়ে দিলে এককি বড়ো যৌগিক বাক্যই পাওয়া যাবে, তাকে মিশ্র বাক্য বলা যাবে না।
মিশ্র বাক্যের উদাহরণ:
আমি জানতাম তুমি আসবে কিন্তু তোমার ভাই আসবে না।
আমরা খেলতাম কিন্তু যত না খেলতাম মজা করতাম তার চেয়ে বেশি।
যদি বৃষ্টি পড়ে তাহলে যাবো না কিন্তু যদি বৃষ্টি না পড়ে তাহলে যাবো।
বাক্যের অর্থগত শ্রেণীবিভাগ
অর্থের ভিত্তিতে বাংলা বাক্যকে ৭ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
নির্দেশক, অনুজ্ঞাসূচক, প্রশ্নসূচক, আবেগসূচক, প্রার্থনাসূচক, সন্দেহবাচক ও শর্তসাপেক্ষ।
নির্দেশক বাক্য
যে বাক্যে সাধারণ ভাবে কোনো বর্ণনা, বিবৃতি, তথ্য ইত্যাদি দেওয়া হয়, তাকে নির্দেশক বাক্য বলে।
যেমন: আমি খেলছি। তুমি গতকাল এসেছিলে। তারা আমার বাড়ি আসবে। হিমালয় ভারতের উত্তর দিকে অবস্থিত।
অনুজ্ঞাসূচক বাক্য
যে বাক্যে কাউকে আদেশ দেওয়া, অনুরোধ করা বা উপদেশ দেওয়া বোঝায়, তাকে অনুজ্ঞাসূচক বাক্য বলে।
যেমন: তুমি আগামীকাল আমার বাড়ি এসো।
আমাকে একটা কলম দাও। এবার সবাই বাড়ি চলো। ছেলেটাকে কষ্ট দিও না।
প্রশ্নসূচক বাক্য
যে বাক্যের দ্বারা কোন প্রশ্ন করা হয় তাকে প্রশ্নসূচক বাক্য বলে।
যেমন: তুমি কি আজ কলকাতা যাবে? আমার সাথে তোমার কখন দেখা হয়েছিল? আজ সকালে কী খেয়েছ?
তোমার আর কত দেরি হবে? তুমি ফুটবল খেলো, তাই না?
প্রশ্নসূচক বাক্যের শেষে একটি প্রশ্ন চিহ্ন দিতে হয়।
আবেগ সূচক বাক্য
যে বাক্যের দ্বারা বক্তার মনের আবেগ বা অনুভূতির প্রকাশ ঘটে তাকে আবেগ সূচক বাক্য বলে।
যেমন: হায় হায়, লোকটার কত কষ্ট! তোমাকে নিয়ে আর পারিনা! এ তুমি কী করলে!
আবেগসূচক বাক্যের শেষে একটি বিস্ময় চিহ্ন থাকে। তাই এই বাক্যকে চেনা খুবই সহজ।
প্রার্থনাসূচক বাক্য বা ইচ্ছাসূচক বাক্য
যে বাক্যের দ্বারা বক্তর মনের ইচ্ছা বা কামনা প্রকাশ পায়
তাকে প্রার্থনাসূচক বাক্য বলে।
যেমন: ঈশ্বর তোমার মঙ্গল করুন। ছেলেটা সুস্থ হয়ে উঠুক। জীবনে অনেক বড় হও।
সন্দেহবাচক বাক্য
যে বাক্যের দ্বারা বক্তার মনের সন্দেহ প্রকাশ পায় তাকে সন্দেহবাচক বাক্য বলে।
যেমন: তোমার নাকি মেয়ের বিয়ে? পাছে কেউ দেখে ফেলে! হয়তো আমাকে তুমি ভুলে গেছো। বুঝিবা এক্ষুনি এসে পড়ে।
সন্দেহবাচক বাক্যে প্রশ্ন, বিস্ময় বা সাধারণ দাঁড়ি চিহ্ন থাকতে পারে। বাক্যের মধ্যে ব্যবহৃত শব্দ ও বাক্যের অর্থ বুঝে সন্দেহবাচক বাক্য চিনতে হয়।
শর্তসাপেক্ষ বাক্য
যে বাক্যে একটি ক্রিয়া সম্পাদনের শর্তে অপর একটি ক্রিয়া সম্পাদিত হয় তাকে শর্তসাপেক্ষ বাক্য বলে।
যেমন: তুমি এলে আমি যাব। সূর্য উঠলে পদ্ম ফুল ফুটবে।
যদি রাম আসে তাহলে শ্যামও আসবে।
অনেকেই মনে করেন শর্তসাপেক্ষ বাক্য মাত্রই জটিল বাক্য। এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল। শর্তসাপেক্ষ বাক্য সরল, জটিল, যৌগিক, তিন প্রকারেরই হতে পারে।
আরও পড়ুন
6 thoughts on “বাক্য ও বাক্যের শ্রেণিবিভাগ | বাক্য”
PRASENJIT SHARMA ধন্যবাদ স্যার
ধন্যবাদ স্যার
ধন্যবাদ স্যার
ধন্যবাদ। স্যার আপনাকে।
Pingback: মাতৃভাষা কাকে বলে? | What is mother tongue in Bengali - Ananyabangla.com
Pingback: শব্দ কাকে বলে - Ananyabangla.com