Ananyabangla.com

ভাষা কাকে বলে? | পশুদের ভাষা ভাষা নয় কেন?

মনুষ্যেতর প্রাণীর ভাষা ও মানুষের ভাষার পার্থক্য

অন্যান্য প্রাণীও মানুষের মতো আওয়াজ করে মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, এমন একটা কথা মাঝে মাঝেই শোনা যায়। তাহলে তাদের আওয়াজকে ধ্বনি বলা হবে না কেন, অথবা তাদের তাদের ভাব প্রকাশের ব্যবস্থাকে ভাষা বলা হবে না কেন? আজকের আলোচনায় ভাষাবৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই প্রশ্নের উত্তর দেবো। 

ভাষা কাকে বলে?

বিভিন্ন ভাষাবিদ্ ভাষার সংজ্ঞা বিভিন্ন ভাবে দিয়েছেন। তাঁদের সকলের মতামতের নির্যাসটুকু নিয়ে ভাষার যে সংজ্ঞাটি দাঁড় করানো যায়, সেটি হলো: মূলত বাগ্‌ধ্বনি দ্বারা গঠিত যে শৃঙ্খলিত ব্যবস্থার দ্বারা অন্তত একটি  জনগোষ্ঠীর মানুষ নিজেদের মধ্যে মনের ভাব বিনিময় করেন তাকে ভাষা বলে। তার মানে ভাষার সংজ্ঞায় আমরা এখানে তিনটে ব্যাপারে গুরুত্ব দিচ্ছি: ১: বাগ্‌ধ্বনির ব্যবহার, ২: শৃঙ্খলিত ব্যবস্থা, অর্থাৎ একটা ব্যাকরণের উপস্থিতি, ৩: ছোটোবড়ো অন্তত একটি জনগোষ্ঠীর ব্যবহারে লাগা। কোনো ভাষা একাধিক গোষ্ঠী ব্যবহার করে, আবার কোনো ভাষা মাত্র কয়েকশো লোকেই ব্যবহার করে। কিন্তু ভাষা হয়ে ওঠার জন্য এই শর্তগুলির বাইরেও আর‌ও কয়েকটি ভাষাবিজ্ঞানসম্মত শর্ত আছে। সেগুলি কী?

ভাষা হয়ে ওঠার শর্ত

স্বীকৃত ভাষা হয়ে উঠতে গেলে একটি ‘ভাষা’-র মধ্যে যে যে বৈশিষ্ট্য থাকতে হবে, সেগুলি হল

১: সাংস্কৃতিক সংক্রমণ (অর্থাৎ প্রাপ্তি)

একটি ভাষাকে তখন‌ই ভাষা বলা যাবে, যখন সেটি সমাজ থেকে শিখতে হবে। মাতৃজঠর থেকে শিখে আসা ভাষাকে ভাষা বলা যায় না। একমাত্র মানুষের ভাষাতেই এই গুণ আছে। তাই কোনো মানবশিশু অন্য পশুদের দ্বারা পালিত হলে বোবা হবে এবং বাঙালি ছেলে ইংলিশ পরিবারে পালিত হলে ইংরেজিই বলবে। অন্য প্রাণীদের ক্ষেত্রে তা হয় না। তারা যেখানেই জন্মাক তাদের ভাষা বয়সের সাথে নিজে নিজেই বিকশিত হয়। পরিবেশ বা সমাজ সেখানে প্রভাব ফেলতে পারে না।

২: স্থান ও কালচ্যুতি

ভাব প্রকাশের সেই ব্যবস্থাকেই ভাষা বলা যাবে, যার দ্বারা উপস্থিত স্থান ও বর্তমান কালের অতিরিক্ত কোনো কিছুর বর্ণনা করা যাবে। যেমন: শুধুমাত্র মানুষের ভাষার দ্বারাই বোঝানো সম্ভব যে, “আগামী বছর আমি নিউ‌ইয়র্কে থাকবো।” অন্য প্রাণীর ভাষায় বড় জোর এইটুকু বোঝানো সম্ভব যে, “ওই দেখো বাঘ আসছে, পালাও।” “আমি গত কাল জঙ্গলের উল্টো দিকে একটা বাঘ দেখেছিলাম।” এই ভাবটি কোনো মনুষ্যেতর প্রাণীর ভাষায় প্রকাশিত হয় না। 

৩: উৎপাদনশীলতা

ভাষা হবে উৎপাদনশীল। একটি নতুন বস্তু বা ধারণার জন্ম বা আমদানি হলে ভাষায় তার জন্য নতুন শব্দ উৎপাদিত হবে। এ ক্ষেত্রে ভাষায় আগে থেকে উপস্থিত উপাদান ব্যবহৃত হবে। 

৪: যাদৃচ্ছিকতা

ভাষার শব্দের সঙ্গে তার অর্থের অনিবার্য কোনো যোগ থাকবে না। যেমন, ‘ওয়াটার’ বোঝাতে বাংলায় ‘জল’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়, আবার এক‌ই অর্থ বোঝাতে ‘পানি’-ও ব্যবহৃত হয়। সুতরাং বোঝা যাচ্ছে জল নামক পদার্থটির সাথে তার নামের কোনো অনিবার্য যোগ নেই। অবশ্য প্রাচীন ভারতীয় ভাষাবিদদের (নিরুক্তবাদী) মতে  শব্দের অর্থ ও তার ধ্বনির মধ্যে অবিচ্ছেদ্য যোগ আছে।

৫: দ্বৈত অস্তিত্ব

একটি ভাষায় একক ধ্বনি ও ধ্বনিগুচ্ছ দ্বারা গঠিত শব্দের অস্তিত্ব পৃথক হয়। জ্, আ, ল্ ধ্বনি তিনটি বাংলা ভাষার উপাদান, কিন্তু এদের কোনো অর্থ নেই। এদের সাজিয়ে নিলে আমরা ‘জাল’ ও ‘লাজ’ শব্দ দুটি পাই। ধ্বনি ও ধ্বনিগুচ্ছ দ্বারা গঠিত শব্দের অস্তিত্ব পৃথক বলেই অল্প কয়েকটি ধ্বনির সাহায্যে আমরা অসংখ্য শব্দ তৈরি করতে পারি।

৬: ভাষা সম্পর্কে ভাষা

‘ভাষা’ তাকেই বলা হবে, যে ‘ভাষা’র দ্বারা ঐ ভাষা সম্পর্কেই কিছু বলা যাবে। যেমন: কোনো কোনো প্রজাতির শিম্পাঞ্জি ইচ্ছে করে মিথ্যে কথা বলে স্বজাতির বন্ধুকে ঠকাতে পারে। কিন্তু ‘মিথ্যা কথা’ এই ভাবটিকে প্রকাশ করতে জানে না, বা তারা কখনোই বলতে পারবে না যে, “চলো আমরা আমাদের মাতৃভাষা দিবস পালন করি।” বা “আমি আমার ভাষাকে ভালোবাসি।”
এই ব্লগের অন্যান্য আলোচনা পড়ার জন্য সূচিপত্র দেখুন

BLOG AD HERE

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *